পাঠাভ্যাসের সংকট: শিক্ষিত সমাজ কেন বই থেকে দূরে?

পাঠাভ্যাসের সংকট: শিক্ষিত সমাজ কেন বই থেকে দূরে?
প্রকাশিত

এক সময় বই ছিল জ্ঞানার্জনের প্রধান মাধ্যম, চিন্তার উৎস এবং সামাজিক সংলাপের কেন্দ্রবিন্দু। আজ সেই বই-ই ক্রমে কোণঠাসা। paradox হলো, শিক্ষার হার বেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস কমেছে। প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি সত্যিই শিক্ষিত হচ্ছি, নাকি কেবল সনদধারী হয়ে উঠছি?

এই পাঠাভ্যাসের সংকট কোনো একক কারণে তৈরি হয়নি; এটি আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনের গতিপথের যৌথ ফল।

ডিগ্রি আছে, পাঠক নেই

বাংলাদেশে এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় যুক্ত। কিন্তু এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশ পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ে না। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নোট, গাইড বা স্লাইডই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র পাঠ্য।

এর ফলে শিক্ষা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তথ্য গ্রহণে, চিন্তা বিকাশে নয়। একজন শিক্ষার্থী হয়তো ভালো ফল করছে, কিন্তু সে নিজে কোনো বই বেছে নিয়ে পড়ছে না, এই বাস্তবতা আজ সাধারণ।

পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ও পাঠাভ্যাসের মৃত্যু

পাঠাভ্যাস ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারণ পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে প্রশ্ন আসে- ‘পরীক্ষায় আসবে কি না’। যে বই পরীক্ষায় আসে না, তা পড়াকে সময়ের অপচয় হিসেবে দেখা হয়।

শিশু বয়সেই যদি বই পড়াকে আনন্দ নয়, বরং বোঝা হিসেবে শেখানো হয়, তাহলে পরবর্তী জীবনে স্বেচ্ছায় বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থাই পাঠাভ্যাসের শত্রুতে পরিণত হয়।

ডিজিটাল যুগের দ্রুততা বনাম গভীর পাঠ

স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথ্যকে সহজলভ্য করেছে, কিন্তু মনোযোগের স্থায়িত্ব কমিয়ে দিয়েছে। স্ক্রল করতে করতে অভ্যস্ত মানুষ দীর্ঘ লেখা পড়তে ধৈর্য হারাচ্ছে।

ফেসবুক পোস্ট, রিলস বা শর্ট ভিডিও তাৎক্ষণিক অনুভূতি দেয়, কিন্তু চিন্তার গভীরতা তৈরি করে না। বই যেখানে ধীর পাঠ দাবি করে, সেখানে ডিজিটাল সংস্কৃতি দ্রুত প্রতিক্রিয়াকে পুরস্কৃত করছে। এই দ্বন্দ্বে বই হারছে।

পরিবার ও সমাজে পাঠ সংস্কৃতির অনুপস্থিতি

এক সময় পরিবার ছিল পাঠাভ্যাস তৈরির প্রথম পাঠশালা। বাবা–মাকে বই পড়তে দেখেই শিশু বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতো। আজ অনেক পরিবারেই বই নেই, আছে কেবল স্ক্রিন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পাঠাগারগুলো অবহেলিত। লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। বই পড়া সামাজিক মর্যাদার অংশ হয়ে উঠতে পারেনি, এটিও একটি বড় সংকট।

পাঠাভ্যাস না থাকলে কী হারাই?

বই না পড়লে শব্দভাণ্ডার সংকুচিত হয়, চিন্তার গভীরতা কমে, সহমর্মিতা দুর্বল হয়। সাহিত্য মানুষকে অন্যের জীবনে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়, ইতিহাস মানুষকে নিজের অবস্থান বুঝতে শেখায়, দর্শন প্রশ্ন তুলতে সাহস দেয়।

পাঠাভ্যাস হারানো মানে কেবল জ্ঞান হারানো নয়; এটি মানবিক ও নাগরিক বোধের ক্ষয়।

শিক্ষিত সমাজের দায়

শিক্ষিত সমাজ যদি বই থেকে দূরে থাকে, তবে সমাজে গুজব, অপতথ্য ও উগ্রতার বিস্তার সহজ হয়। কারণ বই পড়া মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে, যাচাই করতে শেখে। পাঠাভ্যাসের সংকট তাই গণতন্ত্র ও যুক্তিবোধের জন্যও একটি হুমকি।

উত্তরণের পথ

পাঠাভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হলে একে পরীক্ষার বাইরের আনন্দ হিসেবে পুনরাবিষ্কার করতে হবে। স্কুল পর্যায়ে পাঠচক্র, বই আলোচনা, লাইব্রেরিভিত্তিক কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

একই সঙ্গে পরিবার, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক পরিসরে বইকে আবার মর্যাদার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বইমেলা যেন বছরে একবারের উৎসব না হয়ে ওঠে—বরং নিয়মিত পাঠচর্চার অনুপ্রেরণা হয়।

উপসংহার

পাঠাভ্যাসের সংকট আসলে চিন্তার সংকট। আমরা যদি বই থেকে দূরে সরে যাই, তবে গভীরভাবে ভাবার ক্ষমতাও হারাই। শিক্ষিত সমাজের প্রকৃত পরিচয় তার ডিগ্রিতে নয়, তার পাঠে।

প্রশ্ন হলো- আমরা কি শুধু পরীক্ষায় পাস করা প্রজন্ম চাই, নাকি চিন্তাশীল পাঠকসমাজ গড়ে তুলতে চাই?

এই প্রশ্নের উত্তরেই নির্ধারিত হবে আমাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com