ঢাবি ও জাবিতে পিটিয়ে হত্যা: মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) একই দিনে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ লিখেছেন, ‘আগে মানুষ হও, তারপর না হয় জ্ঞানী হইও।’
ঢাবি ও জাবিতে পিটিয়ে হত্যা: মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড়

বুধবার সন্ধ্যার পর চোর সন্দেহে ঢাবিতে তোফাজ্জেল এবং জাবিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীমকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

প্রকাশিত

গত বুধবার সন্ধ্যায় মোবাইল চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশত শিক্ষার্থীর মারধরে ভবঘুরে তোফাজ্জেল হোসেনের মৃত্যু হয়। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 

এরা হলেন: পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মুত্তাকীন সাকিন, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ (২৪), জিওগ্রাফির আল হোসেন সাজ্জাদ ও ওয়াজিবুল আলম। এদের একজন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগী নেতা, অন্যদের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।

এদিকে, জাবিতে শামীম মোল্লা হতক্যার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক ও ছাত্রদলের চার নেতাকর্মীসহ কিছু শিক্ষার্থী জড়িত বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহসান লাবিবকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।  এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আট শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে এবং ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা হলেন: সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. রাজন মিয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজু আহম্মদ, ইংরেজি বিভাগের ৫০ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. মাহমুদুল হাসান রায়হান, ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী হামিদুল্লাহ্ সালমান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিকুজ্জামান আতিক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সোহাগ মিয়া, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব।

সেদিন কী ঘটেছিল ঢাবিতে 

গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টার দিকে ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে আটক করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর তাকে কয়েক দফা পেটানো হয়। রাতে হলের ক্যান্টিনে বসিয়ে তাকে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর আবারও মারধর করা হয় তাকে।

এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এর পরপরই লাশ রেখে হাসপাতাল থেকে যে যার মতো চলে যান শিক্ষার্থীরা।

নিহত তোফাজ্জল হোসেনের বন্ধু মো. বেলাল গাজী মর্গে তার পরিচয় শনাক্ত করেন। তিনি জানান, তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার তালুকচর দোয়ানি গ্রামে। বাবার নাম আব্দুর রহমান। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে একাউন্টিং বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। তবে ৩-৪ বছর ধরে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন তোফাজ্জল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেও থাকতেন।

তোফাজ্জলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বুধবার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বৃহস্পতিবার টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী। সকালে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিলের পর এফ এইচ হলের প্রাধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনেও বিক্ষোভ করেন ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিকেলের দিকে ‘গণতন্ত্রকামী শিক্ষার্থীবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’–এর ব্যানারে ক্যাম্পাসে আরেকটি বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। এসব কর্মসূচি থেকে তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে ‘মব জাস্টিস’ আখ্যা দিয়ে বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা-প্রতিবাদ ও বিচার দাবি করা হয়।

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় দেখতে পান কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী সেখানে শামীমকে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা তাকে টেনে ক্যাম্পাসের ভেতরে নিয়ে আরও কয়েকজন মিলে মারধর করেন।

খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম এবং নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তারা শামীমকে প্রক্টর কার্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার করিডরে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকজন ছাত্র সেখানে গিয়ে শামীমকে আবার মারধর করেন।  রাত সোয়া আটটার দিকে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা গুরুতর আহত শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করলে পুলিশ রাত ৯টার দিকে সাভারের গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক শামীমকে মৃত ঘোষণা করেন।

শামীম মোল্লার মৃত্যুর ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে দিনভর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করেন জাবির শিক্ষার্থীরা। বুধবার রাতেই বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। পরে দুপুরে শিক্ষার্থীদের আরেকটি দলও একই দাবিতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

নিহত শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গত ১৫ জুলাই রাতে ভিসির বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com