

বছর শেষে নতুন উদ্যোম, নতুন বছরের। শিক্ষাঙ্গনে সেই আমেজ সবচেয়ে বেশি। কারণ, নতুন বই এর গন্ধে ভরে উঠবে স্কুল প্রাঙ্গন। নতুন বই পাওয়ার আনন্দে প্রফুল্লিত হবে শিশু-কিশোর মন। নতুন কিছু জানার আলোড়ন চোখমুখে।
তবে, প্রশ্ন হলো- সেই প্রত্যাশার আলোড়ন কতটুকু পূরণ করতে পারছে ‘পাঠ্যবই’?
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি হয় জানার আগ্রহ তৈরি করা, তবে পাঠ্যবই হওয়া উচিত সেই আগ্রহের প্রথম দরজা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্যবই মানে কৌতূহলের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি, বরং হয়ে উঠেছে বোঝা।
প্রশ্ন জাগে, “এই সমস্যার মূল কোথায়? পাঠ্যসূচিতে, নাকি পাঠ্যবইয়ের ভাষা ও ভাবনার কাঠামোতেই?”
ভাষা যখন শেখার প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে
পাঠ্যবইয়ের ভাষা শিক্ষার্থীর বয়স ও মানসিক বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, অনেক বইয়ের ভাষা হয় অতিরিক্ত কাঠিন্যপূর্ণ, নয়তো যান্ত্রিক ও প্রাণহীন। বাক্য দীর্ঘ, ভাব ভারী, ব্যাখ্যা বিমূর্ত, ফলে শিক্ষার্থী পড়ছে ঠিকই, কিন্তু বুঝছে না।
ভাষা যদি বোঝার পথ সহজ না করে, তবে শেখা স্বাভাবিকভাবেই মুখস্থ নির্ভর হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থী তখন বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে পরীক্ষার প্রয়োজনে, জানার আগ্রহ থেকে নয়।
ভাবনার সংকট: তথ্য আছে, প্রেক্ষাপট নেই
বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ের একটি বড় দুর্বলতা হলো- তথ্য থাকলেও ভাবনার বিস্তার নেই। অনেক অধ্যায়ে কী বলা হচ্ছে, তা আছে; কিন্তু কেন বলা হচ্ছে বা বাস্তব জীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী, সে ব্যাখ্যা অনুপস্থিত।
ফলে শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগার সুযোগ তৈরি হয় না। বই যেন উত্তর দেয়, কিন্তু প্রশ্ন করতে শেখায় না। অথচ শিক্ষার প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে প্রশ্ন করার ক্ষমতার মধ্যেই।
কৌতূহল বনাম পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা
পাঠ্যবই প্রণয়নের সময় সবচেয়ে বড় চাপ আসে পরীক্ষাব্যবস্থা থেকে। কোন অধ্যায় থেকে কত নম্বর আসবে, এই হিসাব মাথায় রেখে বই সাজানো হয়। এতে বই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ‘পরীক্ষা প্রস্তুতির গাইড’, জ্ঞানচর্চার মাধ্যম নয়।
ফলাফল হলো- শিক্ষার্থী বই পড়ে পাশ করতে শেখে, কিন্তু জানতে শেখে না। কৌতূহলের জায়গা দখল করে নেয় নম্বরের ভয়।
বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগহীনতা
একটি ভালো পাঠ্যবই শিক্ষার্থীর চারপাশের জগতের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। কিন্তু আমাদের অনেক পাঠ্যবইয়ে বিষয়বস্তু ও বাস্তব জীবনের মাঝে দূরত্ব রয়ে গেছে।
বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান কিংবা সাহিত্য, সব ক্ষেত্রেই উদাহরণগুলো অনেক সময় শিক্ষার্থীর জীবনের অভিজ্ঞতার বাইরে থাকে। এতে বিষয়টি বিমূর্ত হয়ে পড়ে, আগ্রহ নয় বরং অনীহা তৈরি করে।
সৃজনশীলতার অভাব
পাঠ্যবইয়ের ভাষা যদি একমুখী হয়, শুধু বলে যায়, তবে শিক্ষার্থী নিষ্ক্রিয় পাঠকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের পাঠ্যবইয়ে গল্প বলার ধারা, সংলাপ, প্রশ্নভিত্তিক আলোচনা কিংবা ভাবনার জায়গা তুলনামূলকভাবে কম।
ফলে শিক্ষার্থী শেখে গ্রহণ করতে, সৃষ্টি করতে নয়।
শিক্ষকের ওপর বাড়তি চাপ
পাঠ্যবই যদি নিজেই শিক্ষার্থীকে আকর্ষিত করতে না পারে, তবে সেই দায়িত্ব এসে পড়ে শিক্ষকের ওপর। কিন্তু শ্রেণিকক্ষের বাস্তবতায় একজন শিক্ষক সব শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা করে পাঠ্যবইয়ের ভাষা ভাঙিয়ে বোঝাতে পারেন না।
ফলে ভালো শিক্ষক না পেলে পাঠ্যবই আরও বেশি দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, এটি শিক্ষা বৈষম্যকেও বাড়িয়ে তোলে।
কী হওয়া উচিত পাঠ্যবইয়ের ভাষা ও ভাবনা?
একটি কার্যকর পাঠ্যবই-
সহজ কিন্তু তুচ্ছ নয়
প্রাঞ্জল কিন্তু গভীর
তথ্যভিত্তিক হলেও প্রশ্ননির্ভর
পরীক্ষার জন্য নয়, জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক
বাস্তবিক চলাফেরার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ
ভাষা হবে কথোপকথনের মতো, ভাবনা হবে অনুসন্ধানী। অধ্যায়ের শেষে শুধু প্রশ্ন নয়, চিন্তার খোরাক থাকা জরুরি, “তুমি কী ভাবো?”, “এটা তোমার জীবনে কীভাবে প্রযোজ্য?”
উপসংহার
পাঠ্যবই যদি কৌতূহল জাগাতে না পারে, তবে শিক্ষা কেবল আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেয়। আজকের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো, পাঠ্যবইকে আবার শেখার আনন্দের জায়গায় ফিরিয়ে আনা।
প্রশ্ন এখন একটাই-
আমরা কি পাঠ্যবইকে কেবল পরীক্ষার হাতিয়ার বানিয়ে রাখব,
নাকি এটিকে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি জাগানোর প্রধান মাধ্যম করে তুলব?
এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, আমাদের শিক্ষা ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে।