ছন্নছাড়া জনজীবন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন ইতিহাস নয়, এটি আমাদের পরিচয়ের অংশ। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়- আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে কতটা জানছে, আর কতটা অনুভব করছে? পাঠ্যবইয়ে ১৯৭১ আছে ঠিকই, কিন্তু সেই পাঠ কি শিক্ষার্থীদের মনে চেতনার জায়গায় পৌঁছাতে পারছে?
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, প্রায় সব স্তরের পাঠ্যবইয়েই মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায় রয়েছে। শহীদদের আত্মত্যাগ, গণহত্যা, শরণার্থীদের দুর্দশা, বিজয়ের গল্প, সবই আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব বিষয় বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষার্থীদের কাছে পরীক্ষার জন্য পড়া একটি অধ্যায় হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ পড়ানো হয়, কিন্তু অনুভব করানো হয় কম।
পাঠ্যবইয়ের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা এর উপস্থাপনায়। আলোচনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথ্যনির্ভর ও একরৈখিক। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা সামরিক ঘটনাপ্রবাহ উঠে এলেও সাধারণ মানুষের যুদ্ধজীবন, নারীদের অভিজ্ঞতা, গ্রামবাংলার প্রতিরোধ কিংবা শিশুদের মানসিক ক্ষত খুব একটা জায়গা পায় না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে দূরের কোনো ইতিহাস হয়ে থাকে, নিজের জীবনের গল্প হয়ে ওঠে না।
ডিজিটাল সময়ে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের ভাষা ও ধরনও বড় প্রশ্ন। দীর্ঘ বর্ণনা, কঠিন শব্দ আর নিরস উপস্থাপনায় আগ্রহ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ একই ইতিহাস যদি গল্প, ডায়েরি, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা চিত্রভিত্তিক উপস্থাপনায় আসে, তবে তা সহজেই তাদের ভাবনার জগতে জায়গা করে নিতে পারে।
শরণার্থী শিবির, মানবেতর জীবন
পরিবর্তন কোথায়-
১. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিহাস কখনো স্থির নয়। যে ঘটনা অতীতে ঘটেছে, তা যেমন রেকর্ড হয়, তেমনই নতুন প্রেক্ষাপটে সেটিকে পুনঃমূল্যায়ন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক- যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সংঘাতের কারণ, নির্যাতন বা মুক্তিকামী মানুষের অংশগ্রহণ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারার ওপর নির্ভর করে আলাদা আলাদা রঙ পায়।
যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় গঠনকে শক্তিশালী করে, তখন পাঠ্যবই এবং মিডিয়া সাধারণত জাতীয় ঐক্য ও বীরত্বকে তুলে ধরে।
অন্যদিকে, যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা একদম ভিন্ন দলীয় বর্ণনার দিকে ঝুঁকে, তখন ইতিহাসকে ভিন্ন কোণে দেখা হয়- যেমন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা নেতার ভূমিকাকে ঘোলা বা প্রশ্নবিদ্ধ করা।
২. ইতিহাসের “নিরপেক্ষতা” বনাম “দর্শন”
ইতিহাসকে অনেক সময় নিরপেক্ষভাবে লেখা হয়, কিন্তু বাস্তবে এর ব্যাখ্যা প্রায়ই রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে মিশে যায়।
নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ইতিহাস পড়ে থাকলেও, তারা তা বর্তমান রাজনৈতিক আলোকে দেখেই বোঝে। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধকালীন সরকারের নীতি বা নির্দিষ্ট বাহিনীর কাজকে সমালোচনা বা প্রশংসা করা রাজনৈতিক সময়ে বদলে যেতে পারে।
৩. শিক্ষা ও সাহিত্যেও প্রভাব
পাঠ্যবই, প্রবন্ধ, কবিতা বা সাহিত্য সবই প্রভাবিত হয়। সাহিত্যকর্মের মুক্তিযুদ্ধচিত্র, শহীদ ও বীরত্বের চিত্রণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী হালকা বা তীব্র হতে পারে।গবেষণা, প্রামাণ্যচিত্র ও মিডিয়া রিপোর্টও এই দিক পরিবর্তন করে। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস স্থির তথ্য নয়, বরং প্রতিটি সময়ে ভিন্ন বোঝাপড়ার ফলাফল হয়ে ওঠে।
দু মুঠো ভাতের হাহাকার তখনও ছিলো, এখনও আছে
তবু সম্ভাবনার জায়গাটাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখার কথা বলা হচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধ শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় সুযোগ তৈরি করেছে। প্রকল্পভিত্তিক কাজ, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য পাঠ কিংবা প্রামাণ্যচিত্র দেখার মাধ্যমে ইতিহাসকে বইয়ের পাতার বাইরে নিয়ে আসা সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল ডিসেম্বরের আলোচনা নয়, এটি সারা বছরের চেতনার বিষয়। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের আলোচনা, সহশিক্ষা কার্যক্রম ও সাংস্কৃতিক চর্চায় মুক্তিযুদ্ধকে যুক্ত করতে পারলেই নতুন প্রজন্ম ১৯৭১-কে শুধু জানবে না, বুঝতেও শিখবে।
বিজয়ের দিনে দাঁড়িয়ে তাই প্রশ্নটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে- আমরা কি কেবল মুক্তিযুদ্ধ পড়াচ্ছি, নাকি সত্যিকার অর্থে প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বোঝাতে পারছি?