

বিশ্বায়নের এই সময়ে সাহিত্য আর একটি ভাষার ভেতর বন্দি থাকে না। এক ভাষার গল্প অন্য ভাষায় পৌঁছে যায়, এক সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে ফেলে অন্য সমাজকে। এই যাতায়াতের প্রধান সেতু হলো অনুবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই সেতুতে বাংলা সাহিত্য কতটা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে?
বাংলা ভাষার সাহিত্য ঐতিহ্য সমৃদ্ধ, গভীর ও মানবিক। তবু বিশ্বসাহিত্যের মূল আলোচনায় বাংলা আজও প্রান্তিক। এর প্রধান কারণ সাহিত্যিক মানের ঘাটতি নয়, বরং অনুবাদ ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা।
অনুবাদ ছাড়া বিশ্বপরিসরে প্রবেশ অসম্ভব
রুশ সাহিত্য, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বা জাপানি সাহিত্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়েছে দক্ষ ও ধারাবাহিক অনুবাদের মাধ্যমে। টলস্টয়, মার্কেস বা মুরাকামি, এরা কেউই নিজ ভাষার সীমার মধ্যে আটকে থাকেননি।
বাংলা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন মূলত অনুবাদের হাত ধরেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। ফলে বাংলা সাহিত্য আজও বিশ্বপাঠকের কাছে অনেকটাই অচেনা।
বাংলাদেশে অনুবাদচর্চা: বিচ্ছিন্ন ও অনিয়মিত
বাংলাদেশে অনুবাদচর্চা মূলত ব্যক্তিনির্ভর। কিছু প্রকাশনা সংস্থা বা অনুরাগী অনুবাদক ব্যক্তিগত আগ্রহে কাজ করছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুবাদ কখনোই একটি পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক কর্মসূচি হিসেবে গড়ে ওঠেনি।
বাংলা একাডেমি বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো অনুবাদকে নিয়মিত ও কৌশলগত কাজ হিসেবে গ্রহণ করেনি। ফলে অনুবাদ কার্যক্রম রয়ে গেছে খণ্ডিত, অনিয়মিত এবং সীমিত পাঠকের মধ্যে আবদ্ধ।
উল্টো পথে দুর্বলতা: বাংলা থেকে বিশ্বভাষায় অনুবাদ
বাংলাদেশে অনুবাদ বলতে সাধারণত বোঝানো হয়—বিশ্বসাহিত্য বাংলায় আনা। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজি বা অন্যান্য বিশ্বভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
এর ফলে বাংলাদেশের শক্তিশালী সমসাময়িক লেখকরা আন্তর্জাতিক পাঠক, প্রকাশক ও একাডেমিক আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বইমেলা, সাহিত্য উৎসব কিংবা বৈশ্বিক প্রকাশনা বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি তাই দুর্বল।
অনুবাদক সংকট: পেশা হিসেবে অবমূল্যায়ন
বাংলাদেশে অনুবাদ এখনো পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। অনুবাদকদের জন্য নেই নির্ধারিত পারিশ্রমিক কাঠামো, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা বা দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।
ফলে ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্যবোধসম্পন্ন অনেকেই অনুবাদকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান না। এতে একদিকে অনুবাদের মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম এই খাতে আসছে না।
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অনুবাদের প্রান্তিকতা
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনুবাদ শিক্ষা এখনো প্রান্তিক। কিছু ইংরেজি বিভাগে সীমিত কোর্স থাকলেও আলাদা Translation Studies বিভাগ বা গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম নেই বললেই চলে।
এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ অনুবাদক তৈরি হচ্ছে না, আর অনুবাদ রয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশভিত্তিক নীতিগত সুপারিশ
১. জাতীয় অনুবাদ নীতি প্রণয়ন
বাংলাদেশের জন্য একটি সুস্পষ্ট National Translation Policy প্রয়োজন, যেখানে নির্ধারিত থাকবে-
কোন সাহিত্যকর্ম অগ্রাধিকার পাবে
কোন ভাষায় অনুবাদ হবে
মান নিয়ন্ত্রণ ও কপিরাইট কাঠামো
২. জাতীয় অনুবাদ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা
বাংলা একাডেমির অধীনে বা স্বতন্ত্রভাবে একটি National Institute of Translation গঠন করা যেতে পারে, যা-
অনুবাদক প্রশিক্ষণ দেবে
মানসম্মত অনুবাদ প্রকল্প পরিচালনা করবে
আন্তর্জাতিক প্রকাশকদের সঙ্গে সমন্বয় করবে
৩. বাংলা → ইংরেজি অনুবাদে বিশেষ তহবিল
রাষ্ট্রীয় বাজেটে আলাদা করে বাংলা সাহিত্য আন্তর্জাতিকীকরণ তহবিল গঠন করা জরুরি, যাতে-
নির্বাচিত সাহিত্যকর্ম বিশ্বভাষায় অনূদিত হয়
বিদেশি প্রকাশকের সঙ্গে যৌথ প্রকাশ সম্ভব হয়
আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশের সাহিত্য তুলে ধরা যায়
৪. অনুবাদকদের পেশাগত স্বীকৃতি
অনুবাদকদের জন্য-
ন্যূনতম পারিশ্রমিক
রাষ্ট্রীয় পুরস্কার
একাডেমিক স্বীকৃতি
প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যাতে অনুবাদ একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুবাদ শিক্ষা জোরদার
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে Translation Studies বিভাগ চালু করে গবেষণা ও থিসিসভিত্তিক অনুবাদ উৎসাহিত করতে হবে।
৬. ডিজিটাল অনুবাদ প্ল্যাটফর্ম
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একটি ডিজিটাল অনুবাদ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে মানসম্মত অনুবাদ বিশ্বপাঠকের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
উপসংহার
বাংলা সাহিত্য গুণগতভাবে দুর্বল নয়, বরং অনুবাদে অবহেলিত। এই অবহেলা চলতে থাকলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের প্রান্তেই থেকে যাবে।
অনুবাদ তাই আর বিলাস নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রয়োজন।
প্রশ্ন এখন একটাই-
বাংলাদেশ কি বাংলাকে কেবল নিজের জন্য রাখবে, নাকি অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে পৌঁছে দেবে?