

বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষায় ডিজিটাল টুলস এখন আর ভবিষ্যতের কথা নয়; বরং ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ নিচ্ছে। তবে সব উন্নতির মাঝেই রয়েছে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ, যার মূল কারণ অবকাঠামো, দক্ষতার ঘাটতি এবং আর্থসামাজিক বৈষম্য।
ডিজিটাল শিক্ষা সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হলে এই বাস্তবতাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে।
মূল আলোচনা-
১) কাগজ–কলমের বাইরে নতুন শেখার জগৎ
দেশের অনেক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হওয়ায় পাঠদান হয়েছে আরও দৃশ্যমান, সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয়। কঠিন বিজ্ঞান–গণিতের ধারণা ভিডিও, অ্যানিমেশন–গ্রাফিক্সে সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার শক্তি বেড়েছে।
অন্যদিকে গ্রামের কিছু বিদ্যালয়েও এ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে, যেখানে আগে প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল প্রায় অনুপস্থিত।
২) ডিজিটাল ব্যবধান- শিক্ষার নতুন অসমতা
তবে বাস্তবতা আরও জটিল। শহুরে স্কুলগুলো দ্রুত প্রযুক্তি গ্রহণ করলেও, গ্রামীণ স্কুলে একই সুবিধা পৌঁছায়নি। অনেক জায়গায় পুরনো প্রোজেক্টর, দুর্বল ইন্টারনেট বা বিদ্যুতের অনিয়মিত সাপ্লাই ডিজিটাল ক্লাসের ধারাবাহিকতা ভেঙে দেয়।
ডিজিটাল টুলস থাকলেও ব্যবহারের সঠিক দক্ষতা না থাকায় অনেক শিক্ষকই তা নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন না। ফলে প্রযুক্তি ‘শো-পিস’ হয়ে পড়ে—ক্লাসরুমে আছে, ব্যবহৃত হয় না।
৩) শিক্ষক প্রশিক্ষণ: প্রযুক্তির সফলতার কেন্দ্রবিন্দু
ডিজিটাল টুলস যত উন্নতই হোক, তা ব্যবহারের দক্ষতা ছাড়া সবই অকার্যকর। অনেক শিক্ষক মৌলিক আইটি স্কিল না থাকায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে সংকোচবোধ করেন। আবার অনেকে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে পারলেও সময়ের অভাবে তা নিয়মিত আপডেট করতে পারেন না।
শিক্ষক প্রশিক্ষণে ধারাবাহিকতা না থাকলে প্রযুক্তি–নির্ভর শিক্ষা কাগজে–কলমেই থেকে যাবে।
৪) শিক্ষার্থীর মনোযোগ বনাম প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ
ডিজিটাল কনটেন্ট ক্লাসকে আকর্ষণীয় করলেও, স্ক্রিন–নির্ভর শেখার অতিরিক্ততা শিক্ষার্থীর মনোযোগে প্রভাব ফেলতে পারে।
আরেকটি বড় সমস্যা—যেসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে ট্যাব বা মোবাইল দেওয়া হয়, সেখানে নেটওয়ার্ক অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ, গেমিং প্রতিরোধ ও নিরাপদ ব্রাউজিং নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অভিভাবকেরাও শঙ্কায় থাকেন—চাইল্ড–প্রটেক্টেড ডিজিটাল শিক্ষা কতটা নিশ্চিত?
৫) কনটেন্টের মান: সংখ্যা নয়, গুণগত মানই আসল
বাংলাদেশে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরির নানা উদ্যোগ থাকলেও, সব কনটেন্ট সমান মানসম্পন্ন নয়। অনেক কনটেন্ট জটিল, আবার অনেকটি একেবারেই কাঙ্ক্ষিত বয়স উপযোগী নয়।
পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হলে কনটেন্ট হালনাগাদ না থাকায় পুরনো উপাদান দিয়ে ক্লাস নিতে হয়, যা শিক্ষার্থীর শেখায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
মোকাবেলার পথ-
১) অবকাঠামো উন্নয়নকে অগ্রাধিকার
গ্রামীণ ও শহুরে বিদ্যালয়ের প্রযুক্তিগত বৈষম্য কমাতে বিদ্যুৎ–ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে। নষ্ট সরঞ্জাম দ্রুত মেরামত বা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
২) শিক্ষক প্রশিক্ষণের নিয়মিততা
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক সব স্তরে শিক্ষকদের স্কিল আপগ্রেড করার জন্য নিয়মিত, হাতে–কলমে এবং বিষয়ভিত্তিক আইটি প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রশিক্ষণ শুধু ‘টুল ব্যবহার’ নয়, ‘কিভাবে ইন্টারেকটিভ ক্লাস তৈরি করা যায়’—সেটিও শেখাতে হবে।
৩) কনটেন্ট উন্নয়নে গবেষণা ও মান নিয়ন্ত্রণ
পাঠকেন্দ্রিক, বয়স উপযোগী ও আপডেটেড কনটেন্ট তৈরি করতে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে উদাহরণ ও ব্যাখ্যা তৈরি করলে শিক্ষার্থীরা বেশি উপকৃত হবে।
৪) ডিজিটাল সেফটি নীতিমালা
স্কুলে নেটওয়ার্ক ফিল্টারিং, ডিভাইস ব্যবহারে সময় নির্ধারণ, এবং অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। অভিভাবকদেরও যুক্ত করতে হবে যাতে ঘরেও নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহারের চর্চা তৈরি হয়।
৫) টেক–মানসিক ভারসাম্য
শুধু ডিজিটাল শেখা নয়, শিক্ষার্থীর বই–খাতা, আলোচনা–ভিত্তিক ক্লাস এবং খেলার মাধ্যমে শেখার অভ্যাসও বজায় রাখতে হবে। প্রযুক্তি হবে সহযোগী, বিকল্প নয়।
উপসংহার-
ডিজিটাল ক্লাসরুম বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। কিন্তু সম্ভাবনা আর সফলতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাস্তব কিছু বাধা—অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, কনটেন্টের মান, এবং ডিজিটাল বৈষম্য।
যদি পরিকল্পিতভাবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায়, তবে প্রযুক্তি কেবল ক্লাস সাজানোর উপকরণ হবে না—এটি বদলে দেবে শেখার ধরন, স্কুলের পরিবেশ এবং শিক্ষার ভবিষ্যৎ।