

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ এক জটিল মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত ভ্রূণ–প্রযুক্তি, শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার যুগে, দেশে কি শিক্ষার্থীদের মূল জোর থাকা উচিত কারিগরি দক্ষতা তৈরিতে, নাকি মানবিক ও সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে ‘চিন্তাশীল নাগরিক’ গঠনে? এই দ্বন্দ্ব শুধুই শিক্ষাব্যবস্থার নয়; এটি জাতীয় অর্থনীতি, শিল্পনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
কারিগরি শিক্ষা: দক্ষতা এবং চাকরির সরাসরি সম্পর্ক
কারিগরি শিক্ষা মূলত শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দক্ষতায় সজ্জিত করে। বাংলাদেশে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্বাস্থ্যসেবা, বায়োটেকনোলজি, নির্মাণ এবং শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে কারিগরি প্রশিক্ষণের চাহিদা ক্রমেই বেড়েছে। এই ধরনের শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সরাসরি চাকরি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করে, ফলে তাদের কর্মসংস্থান দ্রুত ও সহজ হয়।
শিল্পখাতও কারিগরি দক্ষ মানবসম্পদকে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করেই অর্থোপার্জন শুরু করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি দীর্ঘমেয়াদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের জন্য যথেষ্ট?
জেনারেল শিক্ষা: মনন, বিশ্লেষণ এবং বহুমাত্রিক দক্ষতা
জেনারেল শিক্ষা, বা সাধারণ শিক্ষা, শিক্ষার্থীকে কেবল তথ্যই দেয় না; এটি শেখায় চিন্তা করতে, বিশ্লেষণ করতে, প্রশ্ন তুলতে। ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান, এসব বিষয় শিক্ষার্থীকে মানবিক, নৈতিক ও বুদ্ধিদীপ্ততার দিক থেকে সমৃদ্ধ করে।
একটি দেশের নাগরিকের দায়িত্ব শুধুমাত্র দক্ষ শ্রমিক হয়ে কাজ করা নয়; তার মধ্যে থাকা উচিত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, সমাজ বোঝার দৃষ্টি এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা। জেনারেল শিক্ষা এ ধরনের সামগ্রিক মনন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাজার চাহিদা বনাম সামাজিক প্রয়োজন
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা নীতি প্রায়শই বাজার চাহিদার দিকে বেশি ঝুঁকে। দ্রুত রূপান্তরিত শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর, বিদেশি বিনিয়োগ, সবই কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেয়। ফলে জেনারেল শিক্ষার গুরুত্ব অনেক সময় উপেক্ষিত হয়।
কিন্তু শুধুই দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্ববোধ তৈরি হয় না। দেশের জনসাধারণের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠা করতে জেনারেল শিক্ষার প্রয়োজন অপরিহার্য।
কারিগরি ও জেনারেল শিক্ষার সমন্বয়: প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা
আধুনিক বিশ্বে সফল শিক্ষাব্যবস্থা কেবল একটির ওপর নির্ভর করে না; এটি কারিগরি ও জেনারেল শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হয়। উদাহরণস্বরূপ:
একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে কেবল কোডিং জানা নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ, নৈতিক চিন্তা এবং ব্যবহারকারীর সমাজ বোঝা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবী যদি শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সজ্জিত থাকে, তবে রোগীর মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বোঝাপড়া কমে যাবে।
শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা সঙ্গে সামাজিক ও মানবিক বিশ্লেষণ যোগ করলে উদ্যোগ এবং নেতৃত্বের গুণ বৃদ্ধি পায়।
অতএব, শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘কাজের জন্য দক্ষ মানুষ’ এবং ‘চিন্তাশীল নাগরিক’, দুটোই একসঙ্গে গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের বাস্তবতা
বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান যেমন বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি সাধারণ শিক্ষা ও গবেষণার মানও গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। তবে এখনও সমন্বয় কম। একদিকে চাকরিপ্রাপ্তির চাপ, অন্যদিকে নীতিনির্ধারকদের বাজারমুখী মনোভাব, এই দুইয়ের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা প্রায়শই এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে- চাকরি ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা বনাম ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের চাহিদা।
উপসংহার
কারিগরি বনাম জেনারেল শিক্ষার দ্বন্দ্ব শুধুই শিক্ষাব্যবস্থার নয়; এটি রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। আধুনিক বাংলাদেশে সফল শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হলে দুই দিককে আলাদা না দেখে সমন্বয় করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের কেবল ‘ডিগ্রি অর্জনকারী’ নয়, বরং ‘দক্ষ, মানবিক ও চিন্তাশীল নাগরিক’ হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারিগরি দক্ষতা দিয়ে জীবনকে সহজ করা যায়, কিন্তু জেনারেল শিক্ষা দেয় জীবনকে বোঝার ও সমাজকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা। বাস্তবিকভাবে, সফল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হলে এই দুইয়ের সমন্বয়ই অপরিহার্য।