পাঠ্যবইয়ে সাহিত্য: নম্বরের উপকরণ, নাকি মনন গঠনের হাতিয়ার?

পাঠ্যবইয়ে সাহিত্য: নম্বরের উপকরণ, নাকি মনন গঠনের হাতিয়ার?
প্রকাশিত

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কেবল দক্ষ করে তোলে না, তাদের মনন ও মূল্যবোধও নির্মাণ করে। সেই নির্মাণপ্রক্রিয়ায় সাহিত্যের ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত সাহিত্য আজ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে, সাহিত্য যেন জ্ঞানের বাহন নয়, বরং পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার একটি উপকরণে রূপ নিচ্ছে।

এই পরিবর্তন শুধু পাঠ্যসূচির সমস্যা নয়; এটি আমাদের শিক্ষাদর্শের গভীর সংকটের প্রতিফলন।

সাহিত্য পড়া নয়, ‘উত্তর জানা’ই মুখ্য-

স্কুল-কলেজ পর্যায়ে সাহিত্য পড়ানোর বাস্তব চিত্র বলছে, শিক্ষার্থীদের কাছে গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ আর অনুভবের বিষয় নয়। কোন লাইনে কী প্রশ্ন আসতে পারে, কোন চরিত্র নিয়ে কত নম্বরের উত্তর লিখতে হবে, এই হিসাবেই সাহিত্য সীমাবদ্ধ।

একটি গল্পের মানবিক সংকট, একটি কবিতার অন্তর্গত বোধ কিংবা প্রবন্ধের দর্শন—এসব আলোচনার জায়গা শ্রেণিকক্ষে খুব কমই থাকে। শিক্ষার্থীরা লেখাটি পড়ে না, বরং মুখস্থ করে ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশ’। ফলে সাহিত্য পাঠের মূল উদ্দেশ্য- চিন্তা, সহমর্মিতা ও নৈতিক বোধ তৈরি, তা আর পূরণ হয় না।

পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষায় সাহিত্যের সংকট-

বর্তমান মূল্যায়নব্যবস্থায় সাহিত্যকে দেখা হয় পরীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রশ্ন আসে, ‘কবির নাম লেখো’, ‘মূলভাব লেখো’, ‘চরিত্র বিশ্লেষণ করো’। কিন্তু এই বিশ্লেষণও নির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেয় না।

শিক্ষার্থী যদি ভিন্নভাবে কোনো চরিত্রকে ব্যাখ্যা করে, তা অনেক সময় গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে সাহিত্য, যা মূলত বহুমাত্রিক ব্যাখ্যার জায়গা, সেখানে একমাত্র ‘সঠিক উত্তর’-এর ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটি সাহিত্যের মৌলিক স্বভাবের পরিপন্থী।

পাঠ্যবইয়ের সাহিত্য ও বাস্তব জীবনের দূরত্ব-

পাঠ্যবইয়ে নির্বাচিত অনেক সাহিত্যকর্ম শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ। ভাষা, প্রেক্ষাপট কিংবা বিষয়বস্তু, সবকিছুই অনেক সময় শিক্ষার্থীদের কাছে দূরের মনে হয়। এতে সাহিত্য পাঠের আগ্রহ কমে যায়।

অন্যদিকে সমসাময়িক সমাজ, নাগরিক জীবন, মানসিক টানাপড়েন বা নৈতিক সংকট। এসব বিষয় যদি সাহিত্যের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে উঠে আসত, তবে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে পাঠের সম্পর্ক খুঁজে পেত।

শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদান বনাম আলোচনাভিত্তিক শিক্ষা-

সাহিত্য শেখানোর সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো আলোচনা ও সংলাপ। কিন্তু বাস্তবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদানই বেশি দেখা যায়। শিক্ষক ব্যাখ্যা করেন, শিক্ষার্থীরা নোট নেয়।

এই পদ্ধতিতে সাহিত্য জীবন্ত থাকে না। প্রশ্ন করার, ভিন্নমত প্রকাশের কিংবা নিজের অনুভূতি বলার সুযোগ না থাকলে সাহিত্য কেবল তথ্য হয়ে যায়। অথচ সাহিত্যের কাজই হলো অনুভূতি জাগানো এবং প্রশ্ন তুলতে শেখানো।

মনন গঠনে সাহিত্যের অবদান-

একজন শিক্ষার্থী যখন নিয়মিত সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে মানবিক সংকট, ন্যায়-অন্যায়, প্রেম-বিরহ কিংবা সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে ভাবতে শেখে, তখন তার মধ্যে সহমর্মিতা ও নৈতিকতা তৈরি হয়। এই মনন গঠনের কাজ কোনো কারিগরি বিষয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

সাহিত্য মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়- রাষ্ট্রকে, সমাজকে, এমনকি নিজেকেও।

এই প্রশ্ন করার ক্ষমতাই একজন নাগরিককে চিন্তাশীল করে তোলে।

করণীয় কী?

পাঠ্যবইয়ে সাহিত্যের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। শুধু পরীক্ষায় আসবে এমন লেখা নয়, বরং শিক্ষার্থীর বয়স ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাহিত্য নির্বাচন প্রয়োজন। একই সঙ্গে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে ভিন্নমত ও সৃজনশীল ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য করতে হবে।

শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজন সাহিত্য পাঠদানে বিশেষ প্রশিক্ষণ, যাতে শ্রেণিকক্ষ হয়ে ওঠে আলোচনা ও বিশ্লেষণের জায়গা, নোট মুখস্থের নয়।

উপসংহার-

পাঠ্যবইয়ে সাহিত্য যদি কেবল নম্বর পাওয়ার হাতিয়ার হয়ে থাকে, তবে আমরা শিক্ষিত পরীক্ষার্থী পাব, চিন্তাশীল মানুষ নয়। আর যদি সাহিত্যকে মনন গঠনের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তবে শিক্ষাব্যবস্থা সত্যিকার অর্থেই মানবিক হয়ে উঠবে।

সাহিত্য পড়ানো মানে শুধু কবিতা বা গল্প শেষ করা নয়, এটি মানুষ গড়ার একটি প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই মানুষ গড়তে প্রস্তুত?

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com