
বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে সাময়িক প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেলেও, বছরের বাকি সময়জুড়ে ফিরে আসে দর্শকশূন্যতার চিরচেনা চিত্র। একের পর এক বড় তারকাদের সিনেমা ঈদের জন্য জমিয়ে রাখায় ওই সময়টায় প্রেক্ষাগৃহগুলোতে খানিকটা আলোড়ন তৈরি হয়। তবে ঈদের পরপরই আবার যেন সিনেমার রাজপথ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ছয়টি সিনেমার মধ্যে ‘জ্বীন-৩’ ও ‘অন্তরাত্মা’ খুব একটা সাড়া ফেলতে না পারলেও ‘বরবাদ’, ‘দাগি’, ‘জংলি’ এবং ‘চক্কর ৩০২’ এখনো আলোচনায় রয়েছে। এমনকি এসব সিনেমা দেশের বাইরের বাজারেও প্রতিযোগিতা করছে, যা ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য একটি আশার আলো। কিন্তু এই ক্ষণিক উচ্ছ্বাসের মধ্যেও শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক এবং হল মালিকদের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে গভীর হতাশা।
দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। সিনেমার সোনালি অতীত ফিরে আসবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সংশয়। এক সময় দেশে দেড় হাজারের বেশি প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে পঞ্চাশের নিচে। অনেক প্রেক্ষাগৃহ সারা বছর বন্ধ থাকে, শুধু ঈদের সময় খুলে দর্শকদের টানার চেষ্টা হয়।
সিনেমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র ঈদের সিনেমা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সারা বছরের জন্য ভালো মানের, তারকাসমৃদ্ধ সিনেমার প্রয়োজন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ঈদের বাইরের সময় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর মান নিম্নমুখী, তারকা আকর্ষণ কম এবং নির্মাণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সেগুলো দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এদিকে রোজার ঈদের পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি। অথচ কুরবানির ঈদের সিনেমাগুলো নিয়ে প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। মুক্তির তালিকায় রয়েছে শাকিব খানের ‘তাণ্ডব’, শরিফুল রাজ, তাসনিয়া ফারিণ এবং মোশাররফ করিমের ‘ইনসাফ’, আদর আজাদ-পূজা চেরীর ‘টগর’ এবং আরিফিন শুভ-মন্দীরা চক্রবর্তীর ‘নীলচক্র’। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ঢাকাই চলচ্চিত্রে এখন ব্যক্তি স্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে, ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক স্বার্থ নয়।
বর্তমানে দেশের সিনেমায় দর্শকপ্রিয় তারকার সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। তাও ঈদ ছাড়া বড় বাজেটের সিনেমায় বিনিয়োগ করলে লগ্নি ফেরতের নিশ্চয়তা নেই। এজন্য প্রযোজক ও নির্মাতারা ঈদকেই বেছে নিচ্ছেন। শিল্পীরাও নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য ঈদের সিনেমাকেই টার্গেট করেন।
উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানও এখন ঈদ ছাড়া বড় সাফল্য এনে দিতে পারছেন না। গত বছর ঈদের বাইরে মুক্তি পাওয়া তার সিনেমা ‘দরদ’ ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠে আসে- শুধু দুই ঈদে সিনেমা মুক্তি দিয়ে কি একটি ইন্ডাস্ট্রি বাঁচানো সম্ভব? উত্তরটাও কমবেশি সবার জানা। দর্শকপ্রিয়তার অভাব, মানসম্মত নির্মাণের সংকট এবং তারকাদের সীমিত উপস্থিতি সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এখন টিকে আছে মূলত ঈদনির্ভর হয়ে। বছরের অন্য সময় সিনেমা হলগুলো খাঁ খাঁ করে ফাঁকা পড়ে থাকে, আর প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা লোকসানের বোঝা বইতে থাকেন।
সিনেমা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো বছরের অন্যান্য সময়েও তারকাসমৃদ্ধ ও মানসম্পন্ন সিনেমা মুক্তির উদ্যোগ নেওয়া। না হলে হয়তো এক সময় ঈদের সেই সাময়িক উচ্ছ্বাসও হারিয়ে যাবে।