

এক সময় সিনেমা দেখা মানেই ছিল প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া, টিকিট কাটার লাইন, নির্দিষ্ট শো টাইম, বড় পর্দার আলো-আঁধারিতে ডুবে থাকা সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। সেই অভ্যাসই দীর্ঘদিন ধরে বিনোদন সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু ডিজিটাল বিপ্লব, দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইসের বিস্তারে সেই চিত্র বদলে গেছে। আজ ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম বিনোদনের প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, প্রেক্ষাগৃহ কি তার প্রভাব হারাচ্ছে, নাকি বিনোদনের ধরনই বদলে যাচ্ছে?
ওটিটির উত্থান: সময় ও সুবিধার জয়
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো স্বাধীনতা। দর্শক এখন নিজের সুবিধামতো সময়, জায়গা ও ডিভাইসে কনটেন্ট দেখার সুযোগ পাচ্ছে। সিরিজ হোক বা সিনেমা, সবই অন-ডিমান্ড। এই সুবিধা ব্যস্ত নগরজীবনে দর্শকের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে ওটিটি এখন বিনোদনের প্রথম পছন্দ।
কনটেন্টে বৈচিত্র্য ও সাহসী গল্প
ওটিটির আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো গল্প বলার স্বাধীনতা। সেন্সর ও বাণিজ্যিক চাপে আটকে না থেকে নির্মাতারা এখানে পরীক্ষামূলক ও সাহসী বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারছেন। সামাজিক ট্যাবু, মানসিক স্বাস্থ্য, সম্পর্কের জটিলতা কিংবা রাজনৈতিক বাস্তবতা- সবই জায়গা পাচ্ছে ওটিটি কনটেন্টে। ফলে দর্শক পাচ্ছে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, যা প্রেক্ষাগৃহে সবসময় সম্ভব হয় না।
প্রেক্ষাগৃহের অনন্য অভিজ্ঞতা
তবে প্রেক্ষাগৃহের আবেদন একেবারে হারিয়ে যায়নি। বড় পর্দা, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম ও সম্মিলিত দর্শক প্রতিক্রিয়া, এই অভিজ্ঞতা এখনো অতুলনীয়। বড় বাজেটের সিনেমা, অ্যাকশন বা ভিজ্যুয়াল-নির্ভর গল্প প্রেক্ষাগৃহেই পূর্ণতা পায়। উৎসব মৌসুম কিংবা বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা মুক্তির সময় প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ভিড় এখনো প্রমাণ করে, এই মাধ্যমের শক্তি শেষ হয়ে যায়নি।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও শিল্পের চাপ
ওটিটি বনাম প্রেক্ষাগৃহের দ্বন্দ্বের পেছনে অর্থনীতিও বড় ভূমিকা রাখছে। প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তির সঙ্গে জড়িত বিপুল বিনিয়োগ ও ঝুঁকি। অন্যদিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তুলনামূলক নিরাপদ আয়ের মডেল তৈরি করেছে। ফলে অনেক নির্মাতা এখন সরাসরি ওটিটিতে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। এতে প্রেক্ষাগৃহ-কেন্দ্রিক ব্যবসা মডেল চাপে পড়ছে।
দর্শকের রুচির পরিবর্তন
দর্শকের রুচিও বদলেছে। আগে একটি সিনেমা দেখাই ছিল মূল আকর্ষণ, এখন দর্শক গল্পের গভীরতা, চরিত্রের বিকাশ ও ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা চায়- যা সিরিজ ফরম্যাটে সহজে পাওয়া যায়। এই পরিবর্তিত রুচি ওটিটিকে এগিয়ে দিয়েছে।
সহাবস্থানের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওটিটি ও প্রেক্ষাগৃহ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; বরং তারা সহাবস্থানে টিকে থাকতে পারে। বড় বাজেটের সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে, আর চরিত্রনির্ভর বা পরীক্ষামূলক কনটেন্ট ওটিটিতে, এই সমন্বয়ই ভবিষ্যতের বাস্তবতা হতে পারে। ইতোমধ্যে অনেক সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর ওটিটিতে আসছে, যা নতুন দর্শকও তৈরি করছে।
উপসংহার
ওটিটি বনাম প্রেক্ষাগৃহের এই বিতর্ক আসলে বদলে যাওয়া বিনোদনের অভ্যাসের প্রতিফলন। দর্শক বিনোদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি; সে শুধু নতুন পথ বেছে নিয়েছে। সময়, প্রযুক্তি ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলেই- প্রেক্ষাগৃহ ও ওটিটি উভয়ই নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পারবে। বিনোদনের ভবিষ্যৎ তাই কোনো এক মাধ্যমের একচ্ছত্র আধিপত্যে নয়, বরং বহুমাত্রিক সহাবস্থানের দিকেই এগোচ্ছে।