

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা বলতে আমরা সাধারণত রণাঙ্গন, গুলির শব্দ কিংবা সরাসরি যুদ্ধদৃশ্যের কথা ভাবি। কিন্তু আলমগীর কবির পরিচালিত “জয়যাত্রা” ঠিক সেই চেনা পথ ধরে হাঁটে না।
ছবিটির কাহিনি গড়ে উঠেছে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে ১৯৭১-এর উত্তাল সময়কে ঘিরে। এখানে স্বাধীনতা হঠাৎ করে আসে না, একদিনে জন্ম নেয় না। ধাপে ধাপে মানুষ বদলায়, ভয়ের জায়গায় প্রশ্ন জন্ম নেয়, আর প্রশ্ন থেকেই তৈরি হয় প্রতিবাদ। “জয়যাত্রা” সেই বদলে যাওয়ার গল্পটাই বলতে চেয়েছে।
ইম্প্রেস টেলিফিল্মের, এই ছবিটির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর সংযত নির্মাণ। কোথাও অতিরিক্ত সংলাপ নেই, নেই চড়া আবেগ। চরিত্ররা বক্তৃতা দেয় না, বরং পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেয়। দর্শকও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই নীরবতা আসলে ঝড়ের আগের স্তব্ধতা।
অভিনয়গুলো চোখে পড়ার মতো হলেও চটকদার নয়। সবাই এখানে সাধারণ মানুষ। তাদের ভেতরের দ্বিধা, ভয় আর জমে ওঠা ক্ষোভ খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ পায়। এই বাস্তবতা ছবিটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। মনে হয়, এরা কারও বানানো চরিত্র নয়, এরা সেই সময়ের মানুষ।
চিত্রগ্রহণে আলমগীর কবির সচেতনভাবে ধীর গতি বেছে নিয়েছেন। ক্যামেরা ছুটে চলে না, বরং থেমে থেমে কথা বলে। আলো-ছায়ার ব্যবহার, দীর্ঘ শট, সব মিলিয়ে ছবির ভেতর একটা চাপা অস্থিরতা তৈরি হয়। আবহসঙ্গীত খুব কম ব্যবহার করা হয়েছে, যা নীরবতাকে আরও গভীর করে।
“জয়যাত্রা” আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্র হাতে নেওয়ার গল্প নয়। এটি রাজনৈতিক সচেতনতার গল্প, সাংস্কৃতিক জাগরণের গল্প, আর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের গল্প। কে কখন ভয়ের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে, সেটাই এখানে মুখ্য।
এই সিনেমা হয়তো সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে টানবে না। যারা দ্রুত গল্প এগোনো বা নাটকীয় দৃশ্য আশা করেন, তাদের কাছে ছবিটি ধীর মনে হতে পারে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধকে শুধু ঘটনা নয়, প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে চান, তাদের জন্য “জয়যাত্রা” আলাদা গুরুত্ব রাখে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, “জয়যাত্রা” একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিনেমা, যা মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে যুদ্ধের আগে মানুষের ভেতরে ঘটে যাওয়া লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার জয়যাত্রা যে অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, এই সিনেমা সেটাই শান্ত কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলে যায়।