প্রবাসীর উপার্জন-দেশের অর্থনীতি: অদৃশ্য সম্পর্ক

প্রবাসীর উপার্জন-দেশের অর্থনীতি: অদৃশ্য সম্পর্ক
প্রকাশিত

দেশের অর্থনীতির হিসাবের খাতায় যেসব সংখ্যার দিকে সবচেয়ে বেশি নজর থাকে, তার মধ্যে রেমিট্যান্স অন্যতম। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বাজেট ঘাটতি, আমদানি ব্যয়, সবখানেই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রভাব স্পষ্ট। অথচ এই বিশাল অর্থনৈতিক চক্রের কেন্দ্রে থাকা মানুষগুলো- প্রবাসীরা, থেকে যান আড়ালে। তাদের দৈনিক শ্রম, ঘাম আর ত্যাগের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির যে গভীর ও অদৃশ্য সম্পর্ক, তা খুব কমই আলোচনায় আসে।

রেমিট্যান্স: অর্থনীতির নীরব চালিকাশক্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স কেবল একটি আয় খাত নয়; এটি এক ধরনের নিরাপত্তা বলয়। বৈশ্বিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। কৃষি কিংবা শিল্প খাত যখন চাপে পড়ে, তখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করে।

গ্রামের একটি ছোট বাড়ি, সন্তানের পড়াশোনা, কিংবা পরিবারের চিকিৎসা, এসবের পেছনে লুকিয়ে থাকে প্রবাসীর বিদেশের উপার্জন। এই খরচগুলো স্থানীয় বাজারে চাহিদা তৈরি করে, কর্মসংস্থান বাড়ায় এবং পরোক্ষভাবে জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে।

প্রবাসীর টাকা কোথায় যায়?

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের বড় অংশই যায় দৈনন্দিন ব্যয়ে- খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই খাতে ব্যয় হওয়া টাকা সরাসরি অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবাহিত হয়, যা ভোক্তা চাহিদা বাড়ায়। ফলে ছোট ব্যবসা, কৃষিপণ্য বাজার ও সেবাখাত লাভবান হয়।

একই সঙ্গে রেমিট্যান্স ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জমা হলে তা ঋণ হিসেবে বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ প্রবাসীর উপার্জন শুধু পরিবার নয়, শিল্প ও বাণিজ্য খাতেরও পুঁজি জোগায়।

বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভের সঙ্গে সম্পর্ক

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মূলত নির্ভর করে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর। যখন রপ্তানি আয় কমে যায়, তখন প্রবাসীদের পাঠানো ডলার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে বড় ভূমিকা রাখে। এর ফলে সরকার আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ বজায় থাকে।

এই দিক থেকে প্রবাসীরা কার্যত ‘অদৃশ্য অর্থনৈতিক সৈনিক’। তারা না থাকলে ডলার সংকট আরও তীব্র হতো, যার প্রভাব পড়ত মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ে।

প্রবাসীর ত্যাগ বনাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

অর্থনীতিতে এত বড় অবদান রাখলেও প্রবাসীরা প্রায়ই অবহেলিত। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শ্রম দেন, সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হন। দেশে ফেরার পরও তাদের জন্য টেকসই পুনর্বাসন বা বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত।

অনেক প্রবাসীর উপার্জন সঠিক পথে বিনিয়োগ না হওয়ায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নষ্ট হয়। রাষ্ট্র যদি প্রবাসীদের জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগ স্কিম, সহজ ঋণ সুবিধা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করত, তবে এই ‘অদৃশ্য সম্পর্ক’ আরও দৃশ্যমান ও কার্যকর হতে পারত।

সংকটে রেমিট্যান্সের ভূমিকা

মহামারি, যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় প্রবাসীদের উপার্জনের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। যখন পর্যটন বা রপ্তানি খাত ধাক্কা খায়, তখন রেমিট্যান্সই হয়ে ওঠে অর্থনীতির ভরসা। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে, প্রবাসীর উপার্জন কেবল ব্যক্তিগত আয় নয়, এটি জাতীয় সংকট মোকাবিলার একটি হাতিয়ার।

করণীয়: অদৃশ্য সম্পর্ককে দৃশ্যমান করা

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসীদের অবদান স্বীকার করতে হলে নীতিগত পরিবর্তন জরুরি।

  • প্রবাসীদের জন্য সহজ ও নিরাপদ বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি

  • বৈধ রেমিট্যান্স চ্যানেলে আকর্ষণীয় প্রণোদনা

  • দেশে ফেরত প্রবাসীদের দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান

  • সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোরদার করা

এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে প্রবাসীর উপার্জন দেশের অর্থনীতিতে আরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারবে।

শেষ কথা

প্রবাসীর উপার্জন আর দেশের অর্থনীতির সম্পর্ক চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর প্রভাব অনুভূত হয় প্রতিটি বাজারে, প্রতিটি পরিবারে। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে শ্রমিক দিনভর ঘাম ঝরান, তার সেই ঘামেই সচল থাকে দেশের অর্থনীতির অনেক অদৃশ্য চাকা। এই সম্পর্ককে সম্মান জানানো এবং টেকসই করা, এটাই সময়ের দাবি।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com