ডলার পাঠাতে গিয়ে লোকসান: হুন্ডি বনাম বৈধ চ্যানেল

ডলার পাঠাতে গিয়ে লোকসান: হুন্ডি বনাম বৈধ চ্যানেল
প্রকাশিত

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি ব্যয় মেটানো কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পেছনে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ এই রেমিট্যান্স পাঠাতেই আজ সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ছেন প্রবাসীরা। একদিকে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের জটিলতা ও কম বিনিময় হার, অন্যদিকে হুন্ডির লোভনীয় প্রস্তাব।

এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রবাসী হারাচ্ছেন তার কষ্টার্জিত ডলারের প্রকৃত মূল্য।

বৈধ চ্যানেল: নিরাপদ, কিন্তু কম লাভজনক?

সরকারিভাবে ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস কিংবা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোই সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। এখানে টাকা হারানোর ঝুঁকি নেই, রাষ্ট্র পায় বৈদেশিক মুদ্রা, আর প্রবাসীর পরিবার পায় নিশ্চয়তা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বৈধ চ্যানেলে পাঠানো টাকার বিনিময় হার প্রায়ই বাজারদরের চেয়ে কম থাকে।

একজন প্রবাসী যখন দেখেন, ব্যাংকে পাঠালে প্রতি ডলারে ৩–৫ টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে, তখন তার মাসশেষের হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক শ্রমিক খুব সীমিত আয়ে কাজ করেন। সেখানে এই পার্থক্যই হয়ে ওঠে বড় লোকসানের কারণ।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার জটিলতা, দেরিতে টাকা পৌঁছানো, কখনো কখনো অতিরিক্ত কাগজপত্রের ঝামেলা। ফলে অনেক প্রবাসীর কাছে বৈধ চ্যানেল ‘নিরাপদ হলেও কষ্টকর’ এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।

হুন্ডি: সহজ, দ্রুত কিন্তু ভয়ংকর ফাঁদ

এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছে হুন্ডি চক্র। হুন্ডি মূলত একটি অবৈধ অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা, যেখানে কোনো ব্যাংকিং রেকর্ড ছাড়াই টাকা এক দেশ থেকে আরেক দেশে পৌঁছে যায়।

প্রবাসীর কাছে এর বড় আকর্ষণ-

  • তুলনামূলক বেশি বিনিময় হার

  • মুহূর্তেই দেশে টাকা পৌঁছে যাওয়া

  • কোনো কাগজপত্রের ঝামেলা নেই

কিন্তু এই সহজ পথের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ ঝুঁকি। হুন্ডিতে পাঠানো টাকা যদি মাঝপথে আটকে যায়, প্রতারণার শিকার হন প্রবাসী, তাহলে আইনি কোনো সহায়তা পাওয়ার সুযোগ থাকে না। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দালাল হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে, কিংবা একসময় নিয়মিত টাকা পাঠালেও বড় অঙ্ক পাঠানোর পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

হুন্ডি কেন ক্ষতিকর?

হুন্ডি শুধু প্রবাসীর ব্যক্তিগত ক্ষতিই করে না, এটি সরাসরি দেশের অর্থনীতির জন্যও বড় হুমকি। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো অর্থ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আসে না, ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে না। একই সঙ্গে এই অবৈধ অর্থ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।

যেমন মাদক, চোরাচালান কিংবা অর্থপাচার।

অন্যদিকে, রাষ্ট্র যখন রেমিট্যান্স কম পায়, তখন এর প্রভাব পড়ে ডলার সংকটে, আমদানি ব্যয়ে, এমনকি নিত্যপণ্যের বাজারেও। অর্থাৎ হুন্ডির ক্ষতি শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়েই।

প্রবাসীরা কেন হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন?

প্রশ্ন উঠছে- ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও কেন প্রবাসীরা হুন্ডির পথে হাঁটছেন? এর পেছনে কয়েকটি বাস্তব কারণ রয়েছে-

  • প্রথমত, বৈধ চ্যানেলে প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হারের অভাব।

  • দ্বিতীয়ত, অনেক দেশে এখনও পর্যাপ্ত ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ সুবিধা নেই।

  • তৃতীয়ত, প্রবাসীদের বড় একটি অংশ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত নন।

এই বাস্তবতায় হুন্ডি যেন হয়ে উঠেছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ হলেও লাভজনক’ একটি বিকল্প।

করণীয় কী?

বিশেষজ্ঞদের মতে, হুন্ডি বন্ধ করতে শুধু আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন প্রবাসীবান্ধব নীতি।

  • বৈধ চ্যানেলে বিনিময় হার আরও আকর্ষণীয় করতে হবে

  • টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করতে হবে

  • প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে

  • বিদেশে বাংলাদেশি ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে

প্রবাসীরা যদি দেখেন, বৈধ পথে টাকা পাঠিয়েও তারা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই হুন্ডির প্রতি নির্ভরতা কমবে।

শেষ কথা

প্রবাসীরা শুধু অর্থ পাঠান না, তারা পাঠান স্বপ্ন, ঘাম আর ত্যাগের গল্প। সেই কষ্টার্জিত ডলার যদি ভুল পথে গিয়ে লোকসানে পরিণত হয়। তাহলে তা শুধু একজন প্রবাসীর নয়পুরো দেশের ক্ষতি। হুন্ডি বনাম বৈধ চ্যানেলের এই দ্বন্দ্বে সমাধান একটাই- প্রবাসীদের আস্থা ফেরানো। কারণ প্রবাসীর আস্থা হারালে, রেমিট্যান্সের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা অসম্ভব।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com