বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজ হয়রানি: কেন বাড়ছে সংকট, কোথায় দুর্বলতা

দেশে ফেরা শ্রমিকদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে লাগেজ হারানো, ক্ষতি ও বিলম্ব—সমস্যার মূল কাঠামো কোথায়?
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

প্রকাশিত

বিদেশফেরত শ্রমিকদের হাতে থাকে বহুদিনের পরিশ্রমের ফসল। সেই পরিশ্রমের আয়ের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়েই তারা দেশে ফেরেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে লাগেজ পাওয়া—এর আগের মতো সহজ নেই। লাগেজ হারানো, ভাঙা, দেরিতে পাওয়া কিংবা ভুল গন্তব্যে চলে যাওয়ার ঘটনা এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। প্রবাসীদের এই হয়রানি এখন একটি কাঠামোগত সমস্যায় রূপ নিয়েছে।

লাগেজ-সংকট বাড়ছে কেন?

১. ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেমের দুর্বলতা-

অনেক দেশের বিমানবন্দরের তুলনায় আমাদের ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং অবকাঠামো এখনও পিছিয়ে। স্বয়ংক্রিয়তা কম, ম্যানুয়াল হ্যান্ডলিং বেশি। এর ফলে ব্যাগ পড়া, ভেঙে যাওয়া, কিংবা সঠিকভাবে লোড না হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাকিং না থাকায় কোন লাগেজ কোন পর্যায়ে আছে—তা নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

২. অতিরিক্ত চাপ ও জনবল ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা-

বিদেশফেরত যাত্রীদের বড় অংশই শ্রমিক এবং তাদের লাগেজের সংখ্যা বেশি। অনেক দিন ধরে লাগেজ হ্যান্ডলিং-এ জনবল সংকট থাকায় ওভারলোড পরিস্থিতি তৈরি হয়।

যখন ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ে, তখন একটি লোডিং ইউনিট পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যাগেজ সামলাতে পারে না—ফলে লাগেজ ভুল জায়গায় চলে যাওয়া কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বেড়ে যায়।


৩. নজরদারি ব্যবস্থা দুর্বল—সিসিটিভি ও মনিটরিং যথেষ্ট কার্যকর নয়-

লাগেজ হ্যান্ডলিং এলাকার অনেক অংশে যথেষ্ট সিসিটিভি কাভারেজ নেই। কোথাও হয়তো ক্যামেরা আছে, কিন্তু মনিটরিং নেই। এর ফলে ব্যাগ হারানো বা ভুল ব্যবহারের ঘটনা কোথায় ঘটছে—তা শনাক্ত করা কঠিন হয়।

যে স্টেপে লাগেজ গায়েব হচ্ছে তা চিহ্নিত করা না গেলে দায় নির্ধারণও অস্পষ্ট রয়ে যায়।


৪. ব্যাগেজ লেবেলিং ও অটোমেশন: দুর্বল প্রযুক্তিগত ব্যাবস্থা-

অনেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রিয়েল-টাইম লাগেজ ট্র্যাকিং অ্যাপ, স্মার্ট ট্যাগ, আরএফআইডি সিস্টেম ব্যবহার করে।

কিন্তু দেশের বিমানবন্দরে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত। ফলে লাগেজ হারালে যাত্রী বা কর্তৃপক্ষ—কেউই তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করতে পারে না।


৫. গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতা-

একটি ফ্লাইটে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে-

  • এয়ারলাইন

  • গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার

  • নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ

  • বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ

সমন্বয়হীনতা হলে ব্যাগেজ ম্যানেজমেন্টে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। কোথাও হস্তান্তর ঠিকমতো না হলে সেই ব্যাগেজ পরে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়।

প্রবাসীদের ওপর প্রভাব-

এ ধরনের হয়রানি শুধু ভ্রমণ ঝামেলা নয়—প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির কারণ।

বিদেশে সংগ্রহ করা মূল্যবান জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পুনঃস্থাপন তাদের পক্ষে অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।

এ ছাড়া ফ্লাইটে ১০–১৫ ঘণ্টা ভ্রমণের পর দেশে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাগের অপেক্ষায় থাকা তাদের শারীরিক কষ্ট বাড়িয়ে দেয়।


সমাধানের পথ কোথায়?

১. বিমানবন্দরের ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং পুরো প্রক্রিয়ার স্বয়ংক্রিয়তা বৃদ্ধি-

স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং, স্মার্ট ট্যাগিং, ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও রিয়েল-টাইম স্ট্যাটাস আপডেট করলে লাগেজ হারানো অনেকটাই কমবে।

২. নজরদারি বাড়াতে উচ্চ-রেজোলিউশন সিসিটিভি ও মনিটরিং সেল-

প্রত্যেক ধাপে ক্যামেরা নজরদারি থাকলে অনিয়ম কমবে। একটি বিশেষ মনিটরিং ইউনিট লাগেজ-অভিযোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

৩. গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ-

যারা ব্যাগ সামলান, তাদেরকে দ্রুত, নিরাপদ ও সঠিকভাবে ব্যাগ হ্যান্ডলিংয়ের নিয়ম শেখানো জরুরি। আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন।


৪. যাত্রী অভিযোগ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা-

অভিযোগ দ্রুত সমাধান করার জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম জরুরি:

  • অভিযোগ রেজিস্টার

  • ট্র্যাকিং নম্বর

  • স্ট্যাটাস আপডেট

  • দায় নির্ধারণ

এগুলো এক জায়গায় থাকলে স্বচ্ছতা বাড়বে।

৫. সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করা-

এয়ারলাইন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ—তিন পক্ষের মধ্যে সমন্বয় নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

শেষ কথা

প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাদের উপার্জন থাকা লাগেজ কেবল জিনিসপত্র নয়—তার সাথে জড়িয়ে থাকে পরিবারের প্রত্যাশা, বছরের পরিশ্রমের ঘাম। বিমানবন্দরে লাগেজ–হয়রানি তাদের সেই প্রত্যাশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

কাঠামোগত সমস্যার সমাধান ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া এ সমস্যা কমবে না।

সময়ের দাবি—একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ ও আধুনিক ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা, যেখানে প্রবাসী শ্রমিকরা কোনও হয়রানি ছাড়াই তাদের প্রাপ্য সম্মান নিয়ে দেশে ফিরতে পারেন।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com