

প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া অধিকাংশ বাংলাদেশি শ্রমিকই নির্ভরশীল থাকেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও কফিল (স্পনসর) ব্যবস্থার ওপর। কাগজে-কলমে এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল মনে হলেও বাস্তবে এটি বহু প্রবাসীর জন্য অনিশ্চয়তা, শোষণ এবং অধিকারহীনতার এক দীর্ঘ চক্র তৈরি করেছে।
চুক্তিভিত্তিক চাকরি: নিরাপত্তা নাকি কাগুজে আশ্বাস?
বিদেশে শ্রমিকদের বেশিরভাগ চাকরিই নির্দিষ্ট মেয়াদি চুক্তির আওতায়। দুই বছর বা তিন বছরের চুক্তিতে কাজের শর্ত, বেতন, ছুটি ও সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ থাকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, চুক্তির শর্ত অনেক ক্ষেত্রেই পুরোপুরি মানা হয় না।
কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, বেতন কম দেওয়া, ছুটি বাতিল করা কিংবা কাজের ধরন পরিবর্তন, এসব ঘটে প্রায় নিয়মিত। শ্রমিক আপত্তি করলে সামনে আসে নতুন ভয়, চুক্তি বাতিল, ভিসা নবায়ন না করা, বা দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি। ফলে চুক্তি অনেক সময় শ্রমিকের সুরক্ষা নয়, বরং নিয়োগকর্তার হাতে একচেটিয়া ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত হয়।
কফিল নির্ভরতা: নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র
মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি অঞ্চলে প্রচলিত কফিল ব্যবস্থা প্রবাসী শ্রমিকদের অনিশ্চয়তার মূল উৎস। কফিল বা স্পনসরই নির্ধারণ করেন শ্রমিক কোথায় কাজ করবেন, ভিসা নবায়ন হবে কি না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কর্মস্থল পরিবর্তনের অনুমতিও।
এই নির্ভরতার ফলে শ্রমিক কার্যত হয়ে পড়েন একজন ব্যক্তির অধীনস্থ। কফিল যদি অসন্তুষ্ট হন, তাহলে শ্রমিকের চাকরি, বসবাস ও আইনি অবস্থান, সবই ঝুঁকির মুখে পড়ে। অনেক শ্রমিক বাধ্য হন খারাপ পরিবেশেও কাজ চালিয়ে যেতে, কারণ বিকল্প পথ প্রায় বন্ধ।
কর্মহীন হয়ে পড়ার ভয়
চুক্তি শেষ হলে বা কফিল বদলে গেলে অনেক শ্রমিক হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়েন। নতুন কাজ খোঁজার আইনি সুযোগ সীমিত, ভিসা ট্রান্সফার জটিল, আর সময় খুবই কম। ফলে তারা পড়ে যান অবৈধ অবস্থান, জরিমানা বা আটক হওয়ার ঝুঁকিতে।
এই অনিশ্চয়তা মানসিক চাপকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। পরিবার দেশে বসে নিয়মিত রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে, অথচ প্রবাসী জানেন না, পরের মাসে চাকরি থাকবে কি না।
অধিকার থাকলেও প্রয়োগ নেই
অনেক দেশেই শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত আইন আছে- ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময়, নিরাপত্তা ইত্যাদি। কিন্তু ভাষাগত বাধা, আইনি জটিলতা ও ভয়ভীতি শ্রমিকদের অভিযোগ জানাতে নিরুৎসাহিত করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাগজে আইন থাকলেও বাস্তবে power imbalance বা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে শ্রমিকরা সেই অধিকার ভোগ করতে পারেন না।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও দেশের সঙ্গে সংযোগ
এই কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার সরাসরি প্রভাব পড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে। হঠাৎ চাকরি হারালে প্রবাসী দেশে টাকা পাঠাতে পারেন না, পরিবার সংকটে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে, অনিশ্চয়তার কারণে প্রবাসীরা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় বা বিনিয়োগ পরিকল্পনায় যেতে সাহস পান না। ফলে প্রবাসী আয়ের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগে না।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে করণীয়
শ্রমবাজার বিশ্লেষক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি-
কফিল ব্যবস্থায় সংস্কার ও বিকল্প নিয়োগ মডেল
চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং
কর্মস্থল পরিবর্তনের আইনি সুযোগ সহজ করা
দূতাবাস ও শ্রম উইংয়ের সক্রিয় ভূমিকা
বিদেশ যাওয়ার আগে শ্রমিকদের চুক্তি ও অধিকার বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ
শেষ কথা
কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের সবচেয়ে বড় মানসিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি। চুক্তি ও কফিল নির্ভরতা যদি সুরক্ষার বদলে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তবে প্রবাসী জীবন হয়ে ওঠে এক অনিরাপদ যাত্রা।
প্রবাসীরা শুধু শ্রম দেন না, তারা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখেন। তাই তাদের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই নীতি ও ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।