

প্রবাসী জীবনে নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স কেবল পরিবারের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তারা নানা ধরনের ঝুঁকি, বৈষম্য এবং নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হন। বিদেশে নারী শ্রমিকদের জীবন একদিকে উপার্জনের সুযোগ, অন্যদিকে নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদার লড়াই, এটি এক কঠিন দ্বৈত বাস্তবতা।
দৈনন্দিন বাস্তবতা
নারী শ্রমিকরা সাধারণত গৃহপরিচারিকা, নার্স, নির্মাণ ও সেবা খাতে কাজ করেন। বিদেশে থাকাকালীন তাদের সময় কাটে ঘরে কাজ, বাইরে চলাচল সীমিত, সামাজিক যোগাযোগ কম এবং প্রায়ই একাকিত্বে।
প্রবাসী নারীদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরাপত্তা। অনেক সময় দেখা যায়, কাজের জায়গায় সহকর্মী বা নিয়োগকর্তার দ্বারা শারীরিক বা মানসিক হয়রানি। বাসা বা কর্মস্থলে নিরাপত্তার অভাব, ট্রাফিক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, অথবা জরুরি অবস্থায় সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া, এসব সমস্যা তাদের প্রতিদিনের অংশ হয়ে যায়।
আইনগত ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা
বিভিন্ন দেশে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের জন্য আইন থাকলেও তা সবসময় কার্যকর হয় না। কফিল সিস্টেম, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, এবং স্থানীয় শ্রম আইন তাদের অধিকার রক্ষায় সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
এছাড়া, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বাধা তাদেরকে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। কেউ কেও আদালতে বা পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গেলে স্থানীয় ভাষা না জানার কারণে, অথবা আইনি জ্ঞানের অভাবে সমস্যার সমাধান হয় না।
মানসিক চাপ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি
একেরপর এক চ্যালেঞ্জের মধ্যে নারী শ্রমিকদের মানসিক চাপ ক্রমবর্ধমান।
পরিবার থেকে দূরে থাকা
একাকিত্ব
অতিরিক্ত শ্রম
শারীরিক ও মানসিক হয়রানি
সব মিলিয়ে তাদের মৌলিক মানবিক মর্যাদা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়।
শরীরিক স্বাস্থ্যও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে,
দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ
অপর্যাপ্ত বিশ্রাম
নিরাপদ খাবারের অভাব
সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া
এসব সমস্যার কারণে তাদের স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।
অর্থনৈতিক দায়িত্ব বনাম ব্যক্তিগত স্বার্থ
নারী শ্রমিকদের উপার্জন প্রায়শই পরিবারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তারা দেশের অর্থনীতিতে ও পরিবারের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কিন্তু এই দায় তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বার্থের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অনেক নারী দীর্ঘ সময় নিজের স্বাস্থ্যের উপেক্ষা করে, নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন।
সফল প্রবাসী নারীদের গল্প
তবুও অনেক নারী শ্রমিক এই সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে সফল হয়েছেন। কেউ উদ্যোক্তা হয়েছেন, কেউ সমাজসেবায় সক্রিয় হয়েছেন, কেউ আবার স্থানীয় কমিউনিটিতে নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে এসেছেন। তাদের গল্প দেখায়- সচেতনতা, প্রাপ্য সহায়তা এবং ধৈর্য থাকলে প্রবাসে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা সম্ভব।
করণীয় ও সমাধান
নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষায় কয়েকটি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-
আইনি সচেতনতা ও সহায়তা: প্রবাসীর জন্য বিদেশে শ্রম আইন, চুক্তি ও অধিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা।
নিরাপদ আর্থিক চ্যানেল: রেমিট্যান্স, বেতন ও অন্যান্য অর্থের নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করা।
কমিউনিটি সাপোর্ট ও হেল্পলাইন: দূতাবাস, বাংলাদেশি কমিউনিটি ও এনজিওর মাধ্যমে ২৪/৭ সহায়তা।
প্রাক-প্রবাস প্রশিক্ষণ: ভাষা, সামাজিক দক্ষতা এবং সুরক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
কফিল সিস্টেম সংস্কার: কর্মক্ষেত্রে মনিটরিং ও দায়িত্বশীল নিয়োগকর্তার দায়িত্ব নিশ্চিত করা।
শেষ কথা
বিদেশে নারী শ্রমিকরা শুধু উপার্জনকারী নন, তারা দেশের অর্থনীতি ও পরিবারের স্থিতিশীলতার অদৃশ্য নায়ক। তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা মানে শুধু মানবিক দায় নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য।
প্রবাসী নারী শ্রমিকরা আজকের অচেনা পথে হেঁটে যাচ্ছেন, ভবিষ্যৎ গড়ছেন, পরিবার ভরসা পাচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছেন। এই যাত্রাকে সুরক্ষিত করা আমাদের দায়িত্ব।