

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবল ফসল বা বাসস্থানেই সীমাবদ্ধ নেই; এর সবচেয়ে গভীর ও নীরব আঘাত পড়ছে মানুষের শরীরে। বিশেষ করে পানির লবণাক্ততা বাড়ার ফলে উপকূলবাসীর মধ্যে কিডনি রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো সমস্যা নয়, বরং একটি ধীরে এগিয়ে আসা জনস্বাস্থ্য সংকট।
পানির সঙ্গে ঢুকছে অতিরিক্ত লবণ
দক্ষিণ-পশ্চিম ও উপকূলীয় অঞ্চলের বহু এলাকায় ভূগর্ভস্থ ও পুকুরের পানিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি লবণ মিশে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লবণাক্ত পানি স্থলভাগে ঢুকে পড়ছে। নিরাপদ সুপেয় পানির সংকটে মানুষ বাধ্য হচ্ছে সেই লবণাক্ত পানিই দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে।
এই অতিরিক্ত সোডিয়াম শরীরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে রক্তচাপ বাড়ায় এবং কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন এমন পানি পান করলে কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নারীরা বেশি ঝুঁকিতে কেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকায় নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
এর পেছনে কয়েকটি বাস্তব কারণ রয়েছে-
গৃহস্থালি কাজে দীর্ঘ সময় লবণাক্ত পানির সংস্পর্শ
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ
পানিশূন্যতা ও অপুষ্টি
স্বাস্থ্যসেবায় দেরিতে পৌঁছানো
অনেক নারী নিয়মিত মাথাব্যথা, শরীর ফোলা বা প্রস্রাবের সমস্যাকে সাধারণ ক্লান্তি ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু এসব উপসর্গই ধীরে ধীরে কিডনি জটিলতার ইঙ্গিত দেয়।
নীরব রোগ: ধরা পড়ে দেরিতে
কিডনি রোগকে চিকিৎসকেরা ‘সাইলেন্ট কিলার’ বলেন। শুরুতে তেমন কোনো লক্ষণ না থাকায় রোগী বুঝতেই পারেন না যে তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উপকূলীয় এলাকায় এই সমস্যা আরও ভয়াবহ, কারণ-
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সুযোগ কম
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
ফলে যখন রোগ ধরা পড়ে, তখন অনেক সময় কিডনি ইতোমধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
উপকূলীয় জেলাগুলোর অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিডনি রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। ডায়ালাইসিস সুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে গুরুতর রোগীদের জেলা বা বিভাগীয় শহরে যেতে হয়, যা সময় ও খরচ, দুটোই বাড়িয়ে দেয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, লবণাক্ততা সম্পর্কিত রোগকে এখনো জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি। অথচ এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকি।
সমাধানের পথ কোথায়
এই সংকট মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয়কে জরুরি মনে করছেন-
নিরাপদ সুপেয় পানির টেকসই ব্যবস্থা
উপকূলীয় এলাকায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
নারীদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি
প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগ শনাক্তকরণ
জলবায়ু ও স্বাস্থ্য নীতির সমন্বয়
শেষ কথা
লবণাক্ততা কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানুষের শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়া এক নীরব বিপর্যয়। উপকূলীয় এলাকার মানুষের, বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে থাকলে তা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় চাপ তৈরি করবে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এই নীরব সংকট ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।