আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবী ও রসুলকে নিজ নিজ স্থান ও যুগের চাহিদা অনুপাতে পাঠিয়েছেন। সবশেষ নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একইসঙ্গে আরবভূমি ও সারাবিশ্বের সবার জন্য পাঠিয়েছেন। তাই নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানতে হলে সে সময়ের আরব ভূমির সার্বিক অবস্থা জানা প্রয়োজন। আজকে আমরা তাই জানার চেষ্টা করব।
শিরকের প্রচলন
মক্কার লোকেরা মূলত হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কাবা ঘরকে যথার্থভাবেই আল্লাহর ঘর বা বাইতুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে তাওয়াফ, সায়ি ও হজ করত এবং বহিরাগত হাজিদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত।
কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোনো নবী না আসায় শয়তানি প্ররোচনায় তাদের সমাজনেতা ও ধনিক শ্রেণির অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তি পূজার শিরকের সূচনা হয়, যেভাবে এর আগে নুহ (আ.)-এর সমাজে হয়েছিল।
বিদআতের প্রচলন
মূর্তিপূজা করা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দীনে ইবরাহিমের ওপরে দৃঢ়ভাবে কায়েম আছে। কেননা আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিল যে, এগুলি ইবরাহিমি দীনের বিকৃতি নয়, বরং বিদআতে হাসানাহ। অর্থাৎ ভালো কিছুর সংযোজন মাত্র। এজন্য সে বেশকিছু ধর্মীয় রীতি-পদ্ধতি আবিষ্কার ও চালু করেছিল। যেমন:
(১) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহ্বান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুপারিশ করবে (ইউনুস ১৮)।
(২) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ করত, তাওয়াফ করত, তার সামনে প্রণত হত ও সিজদা করত।
(৩) তারা মূর্তির জন্য মানত ও উপঢৌকন নিয়ে আসত। সেখানে মূর্তির নামে কোরবানি করত (মায়েদাহ ৩)।
দীনে ইবরাহিমিতে উপর্যুক্ত শিরক ও বিদআত সমূহ চালু করার পরেও তাদের অহংকার ছিল এই যে,
(১) তারা ইবরাহিম (আ.)-এর দীনে হানিফ-এর খাঁটি অনুসারী। তারা কাবা ঘরের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। অতএব তাদের সমকক্ষ আরব ভূখণ্ডে কেউ নেই। তাদের এই বড়ত্বের ও আভিজাত্যের অহংকার এতদূর পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা যেহেতু ‘হুম্স’ (حُمْس) অর্থাৎ ‘সবচেয়ে বড় বীর ও বড় ধার্মিক’ অতএব তাদের পক্ষে ‘হারাম’-এর সীমানার বাইরে কোনো ‘হালাল’ এলাকায় যাওয়াটা মর্যাদাকর নয়।
তারা যেহেতু ‘ক্বাত্বীন’ (قطين) বা ‘আহ্লুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা, সেকারণে তারা হজ্জের মওসুমে ‘মুজদালিফায়’ অবস্থান করত, যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে। হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ তাওয়াফে এফাযাহ করত না। যা ছিল হজের সবচেয়ে বড় রুকন। তারা মুজদালিফায় অবস্থান করত ও সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসত। সেজন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন,
ثُمَّ أَفِيْضُواْ مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ
‘এরপর তোমরা ওই স্থান থেকে ফিরে এসো তাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে (অর্থাৎ আরাফাত থেকে) (সুরা বাকারাহ ২/১৯৯)।
(২) তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজিগণ মক্কায় এসে প্রথম তাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় কাপড় (ثياب الحُمْس) পরিধান করবে। সম্ভবত এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থদুষ্ট বিদআত ছিল।
যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তবে পুরুষেরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পরে ত্বাওয়াফ করবে। এতে তাদের দেহ একপ্রকার নগ্নই থাকত।
(৩) তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ির সম্মুখ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু বাকি আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ির পিছন দিকের সরু পথ দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে বৈষম্যগত শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ ظُهُوْرِهَا وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُواْ الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا
‘আর পিছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো মঙ্গল নেই। বরং মঙ্গল রয়েছে আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। তোমরা ঘরে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে’ (সুরা বাকারাহ ১৮৯)।
মদিনার ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের অবস্থা
অপর পক্ষে যারা ইহুদি ও খ্রিষ্টান ছিল, যারা প্রধানত মদিনায় বসবাস করত, যারা অত্যাচারী রাজা বখত নছর কর্তৃক কেনআন (ফিলিস্তিন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে মদিনায় এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বাইতুল মুক্কাদ্দাস হারিয়েছে। অতএব তারা এখন বাইতুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাসিল করবে।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যে, আখেরি নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তার আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তার দীন কবুল করবে এবং তার নেতৃত্বে আবার বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারণা ছিল এই যে, আখেরি নবী অবশ্যই তাদের বংশ থেকেই হবেন। কিন্তু তা না হওয়াতেই হল যত বিপত্তি। তাদের ধর্ম ও সমাজ নেতারা (الأحباروالرهبان) ভক্তদের কাছে ‘রব’-এর আসন দখল করেছিল।
নারীদের অবস্থা
তৎকালীন আরবে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন বসবাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণির লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল। পুরুষ প্রধান সমাজ ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের ছিল মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও ন্যায় ভিত্তিক ব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত।
অপর পক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণির আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল। এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেণীর মত পারস্পরিক সম্মতি ও মোহরানার বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্তু বাকী তিনটি পদ্ধতিকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা যায়।
গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা
আরবদের সামাজিক ব্যবস্থা গোত্র প্রধান হওয়ার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত। মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপরে নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হত। ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণীত হত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। আজকালকের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলি আরবের গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়।
গোত্র সমূহের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারণে তারা অধিক সংখ্যায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককে সবাই সমিহ করত। যুদ্ধে পরাজিত হলে নারীদের সম্ভ্রমহানি ও তাদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দরিদ্রতার কারণে অনেকে কন্যা সন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত।
মক্কায় ‘দারুন নাদওয়া’ ছিল বিখ্যাত। তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশিশক্তিই বিজয় লাভের মানদণ্ড ছিল। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পরিচালিত হত। অবশ্য আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেই উন্নত নয়।
অর্থনৈতিক অবস্থা
ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। তায়েফ, সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি উর্বর এলাকা ছাড়াও অন্যত্র পশু-পালন জনগণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। উট ছিল বিশেষ করে দূরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। মক্কার ব্যবসায়ীগণ শীতকালে ইয়েমেন ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দূরপাল্লার ব্যবসায়িক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সুদের প্রচলন ছিল।
ঘরের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলাকে নিয়োজিত দেখা যেত। কোনো কোনো এলাকায় কৃষিকাজ হত। ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙ্গুরের চাষ হত। মক্কা-মদিনায় গমের আবাদ ছিল না। আমির মুআবিয়ার খেলাফতকালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদিনায় গম রফতানি করা হয়। খেজুর বাগান ব্যাপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।
নিখাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক বিত্তহীন ও মানবেতর জীবন যাপন করত। আজকের বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর চেয়ে মোটেই উন্নত নয়। আরব সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ-জুয়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরূপে বিক্রয় হত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হত।
নৈতিক অবস্থা
উদার মরুচারী আরবদের মধ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ধারা পরিলক্ষিত হত। একদিকে যেমন তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি-হানাহানি লেগে থাকত। অন্যদিকে তেমনই দয়া, উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, দানশীলতা, আমানতদারিতা, মেহমানদারি, প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা ইত্যাদি সদগুণাবলির সমাবেশ দেখা যেত।
তাদের কাব্য প্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের কাছে আধুনিক যুগের আরবি কবি-সাহিত্যিকরা কিছুই নয়। তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল কদাচিৎ হত। সম্ভবত এই সব সৎ গুণাবলীর কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতেই প্রেরণ করেন।
যাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদিস অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীতে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কুরআন ও হাদিস লিখিতভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল।
উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভূখণ্ডের মরুচারী মানুষেরা বিভিন্ন মানবিক দুর্বলতার অধিকারী হলেও তাদের মধ্যে উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঈর্ষণীয়ভাবে পরিদৃষ্ট হত। এই ভূখণ্ডেই হাজার হাজার নবী ও রসুলের আগমন ঘটেছে। এই ভূখণ্ডেই আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ অবস্থিত। এই ভূখণ্ড বাণিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
জান্নাতের ভাষা আরবি এই ভূখণ্ডের কথিত ও প্রচলিত ভাষা ছিল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং সততা ও আমানতদারির অনুপম গুণাবলির প্রেক্ষাপটে আরব ভূমির কেন্দ্রবিন্দু মক্কাভূমির অভিজাত বংশ কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটেই আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত কোরআন ও সুন্নাহর আমানত সমর্পণ করেন।