

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ১৯৪৫ সালে যাত্রা শুরু করা জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য ছিল- যুদ্ধ প্রতিরোধ, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষা। প্রায় আট দশক পর এসে সেই জাতিসংঘই আজ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একটি। গাজা যুদ্ধ, ইউক্রেন সংকট, সুদান ও ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয় কিংবা শরণার্থী সঙ্কট, একটির পর একটি বৈশ্বিক সংকটে প্রশ্ন উঠছে, জাতিসংঘ কি তার ভূমিকা পালন করতে পারছে? নাকি এটি কেবল শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছে?
যুদ্ধ-সংঘাতে জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা-
সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোতে জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকাংশেই প্রতীকী। গাজা যুদ্ধ কিংবা ইউক্রেন সংকটে নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ-ভেটো ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স, এই পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভেটো বারবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আটকে দিয়েছে।
ফলে জাতিসংঘ যুদ্ধ থামাতে নয়, বরং যুদ্ধের পর মানবিক সহায়তা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। সমালোচকদের মতে, এটি জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মানবাধিকার রক্ষায় দ্বৈতনীতি?
জাতিসংঘ নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার বৈশ্বিক অভিভাবক হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে সেখানে দেখা যায় স্পষ্ট দ্বৈতনীতি। কিছু দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হলেও, শক্তিশালী মিত্র রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে জাতিসংঘ প্রায় নীরব।
ফিলিস্তিন, মিয়ানমার বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাস হলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব প্রকট। এতে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতা কমছে।
নিরাপত্তা পরিষদ সংস্কার: কাগজে সীমাবদ্ধ আলোচনা-
জাতিসংঘের সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গ নিরাপত্তা পরিষদ- কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বেশি কাঠামোগত সংকট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত এই পরিষদ আজকের বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে না।
আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা কিংবা মুসলিম বিশ্বের কোনো স্থায়ী প্রতিনিধি নেই। ভারত, ব্রাজিল, জার্মানি, জাপানের মতো দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু স্থায়ী সদস্যদের স্বার্থসংঘাতের কারণে সেই সংস্কার আলোচনা আজও আলোর মুখ দেখেনি।
মানবিক সহায়তায় সাফল্য, কিন্তু যথেষ্ট নয়-
সমালোচনার মধ্যেও জাতিসংঘের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। শরণার্থী সহায়তা, খাদ্য বিতরণ, শিশু ও স্বাস্থ্যসেবা, এই খাতে জাতিসংঘ ও তার সহযোগী সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে।
তবে প্রশ্ন হলো- সংকট প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে কেবল ক্ষত সামলানো কি যথেষ্ট? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর সমাধান নয়।
শক্তিধর রাষ্ট্রের ছায়ায় জাতিসংঘ-
জাতিসংঘের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো, এটি কার্যত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রভাবমুক্ত নয়। অর্থায়ন থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ- সবখানেই বড় শক্তিগুলোর প্রভাব স্পষ্ট।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক অবদান ও রাজনৈতিক অবস্থান জাতিসংঘের অনেক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে উন্নয়নশীল ও দুর্বল দেশগুলো নিজেদের কণ্ঠস্বর হারাচ্ছে।
তাহলে কি জাতিসংঘ অপ্রাসঙ্গিক?
জাতিসংঘ কি তবে তার গুরুত্ব হারাচ্ছে? পুরোপুরি নয়। বরং বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতায় জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। তবে সেটি কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন-
নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত সংস্কার
ভেটো ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা
মানবাধিকার প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান
এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি
উপসংহার-
আজকের বিশ্ব বহুমেরুকেন্দ্রিক, জটিল ও সংঘাতপূর্ণ। এই বাস্তবতায় পুরনো কাঠামোয় পরিচালিত জাতিসংঘ তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে, এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে সংস্কার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে জাতিসংঘ আবারও বৈশ্বিক শান্তি ও ন্যায়বিচারের কেন্দ্রে ফিরে আসতে পারে।
প্রশ্ন একটাই- বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কি সেই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে প্রস্তুত?