

আফ্রিকা আবারও এক অচেনা পুরোনো বাস্তবতার মুখোমুখি। একের পর এক দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, ক্ষমতা দখল এবং সংবিধান স্থগিতের ঘটনা মহাদেশটিকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে মধ্য আফ্রিকা, গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি ক্রমে চাপা পড়ছে সেনাশাসনের বুটের নিচে। প্রশ্ন উঠছে, এটি কি সাময়িক অস্থিরতা, নাকি আফ্রিকার রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি এক মোড় পরিবর্তন?
অভ্যুত্থানের নতুন মানচিত্র
গত কয়েক বছরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান বা সামরিক ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে সাহেল অঞ্চল- মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার এই তিন দেশ যেন নতুন এই ঢেউয়ের প্রতীক। এর বাইরে মধ্য আফ্রিকার কিছু দেশেও সেনাবাহিনীর প্রভাব ক্রমেই রাজনৈতিক কাঠামোকে গ্রাস করছে।
এই অভ্যুত্থানগুলো কেবল ক্ষমতা বদলের ঘটনা নয়; এগুলো বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর জনঅসন্তোষের প্রতিফলনও বটে।
কেন আবার সেনাবাহিনী?
বিশ্লেষকদের মতে, আফ্রিকায় সামরিক হস্তক্ষেপের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ কাজ করছে-
১. নিরাপত্তা সংকট-
জঙ্গিবাদ, সশস্ত্র বিদ্রোহ ও সীমান্ত অস্থিতিশীলতা বহু দেশে বেসামরিক সরকারকে দুর্বল করেছে। জনগণের চোখে সেনাবাহিনী তখন ‘শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার শক্তি’ হিসেবে হাজির হয়।
২. দুর্নীতি ও শাসন ব্যর্থতা-
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ভোট কারচুপি ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ জমতে জমতে বিস্ফোরণের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
৩. বিদেশি প্রভাব নিয়ে ক্ষোভ-
ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিনের সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি অনেক দেশে জনরোষের কারণ হয়ে উঠেছে। সেনা সরকারগুলো এই ক্ষোভকে ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী ভাষ্য তৈরি করছে।
অভ্যুত্থানের চরিত্র বদলেছে কী?
নব্বইয়ের দশকের অভ্যুত্থানের সঙ্গে বর্তমান ঢেউয়ের একটি বড় পার্থক্য আছে। তখন সেনাশাসন মানেই ছিল সরাসরি সামরিক শাসন।
এখন দেখা যাচ্ছে-
অভ্যুত্থানের পর “অন্তর্বর্তী সরকার” ঘোষণা
গণতন্ত্রে ফেরার প্রতিশ্রুতি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক জনসমর্থনের প্রদর্শন
তবে বাস্তবে এই অন্তর্বর্তী সময় দীর্ঘায়িত হচ্ছে, আর ক্ষমতা ধীরে ধীরে কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নতুন মেরুকরণ
আফ্রিকার এই সামরিক ঢেউ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলছে।
পশ্চিমা দেশগুলো অভ্যুত্থানের নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
অপরদিকে, কিছু সেনা সরকার বিকল্প আন্তর্জাতিক অংশীদারের দিকে ঝুঁকছে।
আঞ্চলিক জোটগুলো অভ্যুত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে আফ্রিকা নতুন এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে পরিণত হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের বাস্তবতা
অভ্যুত্থানের পেছনে জনঅসন্তোষ থাকলেও এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে
আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাচ্ছে
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় সংকুচিত হচ্ছে
গণতন্ত্রের বদলে নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নাগরিক অধিকার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
সামনে কোন পথ
প্রশ্ন হলো, এই সামরিক ঢেউ কোথায় গিয়ে থামবে?
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু নির্বাচন আয়োজন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন-
কার্যকর ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা
নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ভারসাম্য
বিদেশি প্রভাবের পরিবর্তে আঞ্চলিক সক্ষমতা বৃদ্ধি
নচেৎ অভ্যুত্থান আফ্রিকার রাজনীতিতে একটি “নিয়মিত ঘটনা” হয়ে উঠতে পারে।
উপসংহার
আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থানের এই ঢেউ কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়; এটি শাসনব্যবস্থার গভীর সংকটের বহিঃপ্রকাশ। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার মধ্যকার ভারসাম্য খুঁজে না পেলে আফ্রিকা বারবার ফিরে যাবে সেনাশাসনের পুরোনো চক্রে। এই সংকটের সমাধান শুধু আফ্রিকার নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এক বড় পরীক্ষা।