রোহিঙ্গা সংকট: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত?

রোহিঙ্গা সংকট: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত?
প্রকাশিত

বিশ্ব রাজনীতির আলো-আঁধারিতে বহু সংকট আসে, বহু সংকট হারিয়ে যায়। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট, হারিয়ে যায়নি, বরং বছরের পর বছর ধরে জমে উঠেছে এক গভীর মানবিক ট্র্যাজেডি হিসেবে। ২০১৭ সালের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আজ প্রশ্ন উঠছে সেসব প্রতিশ্রুতি আদৌ কতটা বাস্তবে রূপ পেয়েছে?

প্রতিশ্রুতির পাহাড়, বাস্তবতার খরা

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো শুরুতে রোহিঙ্গা সংকটকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ত্রাণ, খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় নিশ্চিত করতে বিপুল অর্থ সহায়তার ঘোষণাও এসেছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক মনোযোগ ততই অন্য সংকটে সরে গেছে- ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংকট কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা রোহিঙ্গাদের অবস্থানকে আরও প্রান্তিক করে তুলেছে।

আজ বাস্তবতা হলো, প্রয়োজনের তুলনায় সহায়তা ক্রমাগত কমছে। খাদ্য রেশন সংকুচিত হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি বাড়ছে, শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ছে। প্রতিশ্রুত অর্থের বড় একটি অংশ কাগজে-কলমেই থেকে গেছে।

প্রত্যাবাসন: কথার ফুলঝুরি, অগ্রগতি শূন্য

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার ছিল- রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রত্যাবাসন আজও অধরা। মিয়ানমারে নিরাপত্তা পরিস্থিতির কোনো টেকসই উন্নতি হয়নি, বরং নতুন করে সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একাধিক বৈঠক, চুক্তি ও রোডম্যাপ তৈরি হলেও মাঠপর্যায়ে তার বাস্তব প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে প্রত্যাবাসনের নামে চলছে কেবল সময়ক্ষেপণ, আর শরণার্থী শিবিরে বেড়ে উঠছে হতাশ প্রজন্ম।

মানবাধিকার প্রশ্নে দ্বৈত নীতি

রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবাধিকার অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একদিকে মানবাধিকারের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ বক্তব্য, অন্যদিকে কার্যকর চাপ প্রয়োগে অনীহা, এই দ্বৈত নীতি স্পষ্ট। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা পরিস্থিতি বদলাতে সক্ষম হয়নি।

আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার অগ্রগতি ধীরগতির, অপরাধীদের জবাবদিহি এখনও অনিশ্চিত। এতে বার্তা যাচ্ছে একটাই- গণহত্যার মতো অপরাধ করেও দায় এড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশের ওপর বাড়তি চাপ

এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সবচেয়ে বড় বোঝা বহন করছে বাংলাদেশ। জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও পরিবেশ সব ক্ষেত্রেই চাপ বাড়ছে। কক্সবাজার অঞ্চলের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, স্থানীয় জনগণের মধ্যেও অসন্তোষ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এই সংকট এখন কেবল মানবিক নয়, বরং কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।

হারিয়ে যেতে বসা একটি প্রজন্ম

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎহীন একটি প্রজন্মের জন্ম। শিবিরে বেড়ে ওঠা লাখো শিশু পর্যাপ্ত শিক্ষা, মানসিক যত্ন ও স্বপ্নের সুযোগ পাচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদে এই অবহেলা শুধু রোহিঙ্গাদের নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে কঠিন প্রশ্ন

রোহিঙ্গা সংকট আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিকতার আয়না। মানবাধিকার কি কেবল রাজনৈতিক সুবিধার বিষয়? প্রতিশ্রুতি কি শুধু সংকটের শুরুতেই দেওয়ার জন্য? নাকি বাস্তবায়নের দায়ও বিশ্বশক্তিগুলোর আছে?

এই সংকটের টেকসই সমাধান চাইলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কেবল সহানুভূতি নয়, কার্যকর রাজনৈতিক চাপ, পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। নইলে রোহিঙ্গা সংকট ইতিহাসে লেখা থাকবে- একটি জনগোষ্ঠীর নয়, বরং বৈশ্বিক বিবেকের ব্যর্থতার গল্প হিসেবে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com