চালের দাম বাড়লেও বাড়েনি ঘামের দাম: জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ

চালের দাম বাড়লেও বাড়েনি ঘামের দাম: জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ
প্রকাশিত

বাংলাদেশে গত এক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে চালের লাগামহীন দাম বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে। অথচ, শ্রমিকের ঘামের মূল্য, অর্থাৎ বেতন, মজুরি এবং ভাতা আনুপাতিক হারে বাড়েনি। উল্টো অনেক ক্ষেত্রে তা কমেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। একদিকে যেমন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব এবং বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান হার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি: এক বছরের চিত্র

গত ১২ মাসে বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০২৪-এ ৯.৭২% এবং মে ২০২৫-এ ৯.০৫% ও জুন ২০২৫-এ ৮.৪৮% পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগজনক। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক বছরের মধ্যে ১৪.১% পর্যন্ত বেড়েছিল জুলাই ২০২৪-এ, যদিও মে ২০২৫-এ এটি কিছুটা কমে ৮.৫৯% হয়েছে।

চালের দাম: টিসিবির তথ্যমতে, গত এক বছরে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি নাজিরশাইল চালের দাম ৬০-৭৮ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫-৮৫ টাকা হয়েছে। পাইজাম চাল ৫৪-৫৮ টাকা থেকে বেড়ে ৬০-৭৫ টাকা এবং ইরি চাল ৫০-৫৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ, চালের দাম গড়ে ১৫-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বোরো মৌসুমে ভালো ফলন এবং ১৩ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি হওয়া সত্ত্বেও দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

অন্যান্য নিত্যপণ্য: ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, শাক-সবজি, মাংস ও ডিমের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম ১৬০-১৭০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭০-১৮০ টাকা এবং ডিমের ডজন ১৩০-১৪০ টাকায় পৌঁছেছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পরিবহন খরচ বাড়িয়েছে, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে।

জীবনযাত্রার ব্যয়বহুলতা ও আয়ের অসঙ্গতি

দ্রব্যমূল্যের এই লাগামহীন বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়কে অসহনীয় করে তুলেছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য বেঁচে থাকাটাই এখন একটি সংগ্রাম। শহরাঞ্চলে জীবনযাত্রার ব্যয় গত এক বছরে প্রায় ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় এই বৃদ্ধির হার ১০%। অথচ, বেতন, মজুরি বা ভাতার বৃদ্ধির হার অনেক কম, মাত্র ৪-৫ শতাংশের বেশি নয়। ট্রেডিং ইকোনমিক্সের তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম মজুরি ডিসেম্বের ২০২৫ পর্যন্ত ১২,৫০০ টাকা/মাস অপরিবর্তিত রয়েছে।

প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি নেতিবাচক: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ৪১ মাস ধরে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি নেতিবাচক। অর্থাৎ, মুদ্রাস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে, যার ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। জুলাই মাসে মজুরি বৃদ্ধি ৭.৯৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। এটি অন্তত এক দশকের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি এবং মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে সর্বোচ্চ ৩.৭৩ শতাংশীয় পয়েন্টের ব্যবধান।

রিকশাচালক আব্দুল করিমের মতে, "আগে সারাদিন খেটে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করলেও এখন ৫০০-৬০০ টাকা আয় করেও সংসার চালানো কঠিন। সবকিছুর দাম বেড়েছে, কিন্তু আমাদের আয় বাড়েনি। ঘাম ঝরাচ্ছি আগের চেয়ে বেশি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না।"

মূল্যবৃদ্ধির কারণ ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ

ব্যবসায়ীদের মতে, চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ:

• পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি: কোরবানি ঈদ ও ফল মৌসুমের কারণে ট্রাকের চাহিদা বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে।

• ধানের দাম বৃদ্ধি: কৃষকদের ধান মজুত প্রবণতা এবং ধানের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ধানের দাম বাড়িয়েছে।

• করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মজুত: বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রিম টাকা দিয়ে ধান কিনে মজুত করায় ছোট মিল মালিকেরা ধান পাচ্ছেন না।

• আমদানি বন্ধ ও উচ্চ শুল্ক: ১৫ এপ্রিলের পর চাল আমদানির অনুমতি ও শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আমদানি বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে চাল আমদানিতে মোট শুল্ক-কর সাড়ে ৬৭ শতাংশ।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, "এই পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো নয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করবে। সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।"

তারা শুধু মুদ্রানীতির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, সঠিক সময়ে আমদানি নিশ্চিত করা এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আস্থা ফিরিয়ে আনবেন এবং বাজারে সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করি।

সরকারের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেওয়া হলেও, বাস্তবে এর তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সাধারণ মানুষ এখন তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে তাদের ঘামের সঠিক মূল্য দেওয়া হবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, চালের দাম বাড়লেও 'ঘামের দাম' বাড়ার জন্য আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com