‘‘আসন্ন শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ও শ্রমিকের প্রত্যাশা’’ শীর্ষক আলোচনা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত

আজ ‘‘বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের প্রয়াত সভাপতি শাহ আতিউল ইসলামের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
‘‘আসন্ন শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ও শ্রমিকের প্রত্যাশা’’ শীর্ষক আলোচনা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত
প্রকাশিত

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের প্রয়াত সভাপতি শাহ আতিউল ইসলামের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে আলোচনা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বুধবার (২২ অক্টোবর) সকাল ১১টায় রাজধানীর হাতিরপুলে ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘আসন্ন শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ও শ্রমিকের প্রত্যাশা‘ শীর্ষক এই আলোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সভায় সভাপতিত্ব ও লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের তাসলিমা আখতার।

আলোচনায় অংশ নেন ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সহসাধারণ সম্পাদক আলিফ দেওয়ান, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির যুগ্ম সম্পদক প্রবীর সাহা, বাংলাদেশ বহুমুখী শ্রমজীবি ও হকার সমিতির সভাপতি বাচ্চু ভুইয়া, পুস্তক বাধাই শ্রমিক ইউনিয়েনের কোষাধক্ষ্য সোহেলা রুমি ও অন্যান্য শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।

এর আগে সকালে বুদ্ধিজীবি কবরাস্থানে এবং কেন্দ্রীয় কার্যালে শাহ আতিউল ইসলাম স্মরনে পুস্পার্ঘ অর্পন করা হয় ও ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

আলোচনা অনুষ্ঠানে পঠিত লিখিত বক্তব্যটি নীচে সংশোধনসহ দেয়া হলো-

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন বাজাফে ১২-এর পক্ষ থেকে আপনাদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। আজ এই জাতীয় ফেডারেশনের প্রয়াত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আজীবন সংগ্রামী শাহ আতিউল ইসলামের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। করোনাকালে তিনি করোনাক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে যান। আজ তাঁর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী আমরা এমন সময় পালন করতে যাচ্ছি যখন খুব শীঘ্রই ঐতিহাসিক মুহুর্ত আসবে। দেশে শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়ন হতে যাচ্ছে। শাহ আতিউল ইসলাম চিরজীবন শ্রমিকের জন্য গণতান্ত্রিক আইন, সংগঠন-মত প্রকাশের অধিকার এবং নারী পুরুষ শ্রমিকের জন্য সংগঠনের আইনি বাধা দুর করে সংগঠন রেজিস্ট্রেশন প্রশ্নটি বারবার শ্রমিক আন্দোলনে উত্থাপন করেছেন। শাহ আতিউল ইসলামসহ বাংলাদেশে সকল শ্রমিক স্বার্থের পক্ষর জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বরা চেয়েছিলেন শ্রমিক সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্রম আইন সংশোধন করবে। এবং শ্রমিক ফেডারেশনসমূহকে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হোক। আজ যখন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিশেষ আন্তরিকতায় শ্রমিক এবং শ্রমখাতের উন্নয়নে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আইন পরিবর্তন-সংশোধন এবং সংস্কার হতে যাচ্ছে তখন শাহ আতিউল ইসলামসহ প্রয়াত ও জ্যেষ্ঠ্য সকল নেতাকে স্মরণ করতে চাই। যাদের সাথে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে।

আমরা স্মরণ করি সাম্প্রতিক মিরপুরে পোশাক কারখানায় আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো ও আহত শ্রমিকদের। তাদের ন্যায় বিচার বিষয়টিও আমরা সরকারকে বিশেষ বিবেচনায় রাখতে বলি। আমরা বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই প্রধান উপেদেষ্টাসহ সকল উপদেষ্টামন্ডলীকে এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সকল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যারার ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদকে সাথে নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের সামনে শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ হাজির করার উদ্যোগ নিয়েছে। সারা দেশের শ্রমিক-দেশবাসী, দেশী আন্তর্জাতিক মহল তাকিয়ে আছে, অপেক্ষায় আছে এই অধ্যাদেশ আমাদের কী দিতে যাচ্ছে সেই প্রতিক্ষায়। আমরা আশা করি, আসন্ন অধ্যাদেশ শ্রমিকস্বার্থ, শ্রম খাত-জাতীয় অর্থনীতির বিকাশকে অগ্রাধিকার দিবে। সরকার-শ্রমিক-মালিক ৩ পক্ষের স্বার্থ, জাতীয় অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপান্তরের প্রশ্ন পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু আসন্ন অধ্যাদেশ নিয়ে আমরা যেমন বিশেষভাবে আশাবাদী তেমনি এখনো সংশয়-আশঙ্কা আছে আমাদের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার সামগ্রিক প্রতিফলন আমরা আসন্ন শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশে পাবো কি না সে বিশয়ে। সরকার গত বছর সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদকে প্রধান করে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনের সুপারিশের ফলাফল কতটা প্রতিফলিত হয়ে তাও আমরা জনিতে চাই। সেই বিষয়ে আমাদের প্রত্যাশা, সংশয়, শঙ্কা ও করনীয় নিয়ে আমাদের আজকে আলোচনা।

আপনারা জানেন ৫ আগস্ট ২০২৪ হাজারো প্রাণের বিনিময়ে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে তাতে শহীদদের বেশীরভাগ শ্রমজীবি মানুষ। শ্রমজীবি, ছাত্র-তরুন-নারী-পুরুষ জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। তাই আশা করি বিচার-সংস্কার-নির্বাচন সরকারের রোড ম্যাপের মধ্যে কোনভাবেই শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়টি হারিয়ে যাবে না। আমরা আমাদের প্রত্যাশা ও সংশয় নীচে পুনর্বার ব্যক্ত করছি।

১. নির্বাচনী তফসীল ঘোষণার আগে অবশ্যই শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। অধ্যাদেশ জারি করতে হবে।

২. শ্রমিক প্রাণহানির বিচার সম্পন্ন করা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান: গণঅভ্য্যত্থানে প্রাণ হারোনা হাজারো শ্রমিক তরুণ ছাত্র জনতার মধ্যে শহীদ শ্রমিক রানা প্লাজা, তাজরীনসহ বিভিন্ন কারখানায় অবকাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে হাজারো শ্রমিকের প্রাণহানি বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় বিরল ঘটনা। এসব ঘটনা শ্রমিক পরিবার এবং শ্রমিকের জীবনে যেমন ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকেছে তেমনি বৈশ্বিক পর্যায়েও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। কিন্তু এ যাবতকাল বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি। এমনকি, রানা প্লাজায় প্রায় ১১৭৫ জনের প্রাণহানি ঘটলেও ১৩ বছরেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়নি। এক্ষেত্রে সকল কাঠামোগত দুর্ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা দরকার। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ এবং রানা প্লাজা ও তাজরীনের ঘটনার মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং মর্যাদাপূর্ণ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে।

২. আইন-আদালতে বাংলা ভাষা ও বৈষম্যহীন ভাষা ব্যবহার: শ্রম আইনে মর্যাদাকর-বৈষম্যহীন বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত প্রয়োজন। এবং শ্রম আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্তও সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহার ও বাংলায় রায় প্রদান নিশ্চিত প্র্রয়োজনীয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে শ্রম আইন বা আদালতের রায় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা দরকার। শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি-ধর্মসহ অন্যান্য যে কোনো বৈষম্যমূলক ও কৌশলপূর্ণ শব্দ আইনে ব্যবহার বন্ধ করে মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে ভাষার প্রয়োজনীয় সংশোধন জরুরি। যেমন: শ্রম পরিবেশে শ্রমিকদের তুই/তুমি সম্বোধন আইনিভাবে বন্ধ করা, আইনের সকল স্থানে ‘মহিলা’ শব্দের পরিবর্তে ‘নারী’ শব্দ প্রতিস্থাপন, উপজাতি শব্দ ব্যবহার না করে আদিবাসী ও বহু জাতি শব্দ ব্যবহার করা। একইসাথে প্রচলিত ইংরেজি শব্দ প্রয়োজনে বাংলা উচ্চারণে বাংলা অক্ষরে লিখা।

৩. জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কমিশন, স্থায়ী শ্রম কমিশন, সামাজিক সংলাপ ফোরাম গঠন ও মজুরি নির্ধারণ কাল ৩ বছর অন্তর: বাংলাদেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কমিশন গঠন ও মর্যাদাপূর্ণ মজুরি নির্ধারণের শর্ত আইনে সংযোজন প্রয়োজন। সেক্টরাল মজুরি ৫ বছর পর পর পুনর্নির্ধারণের বদলে ৩ বছর পর পুনর্নির্ধারণ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় মজুরিও নির্ধারন কাল ও একইভাবে করা দরকার। মর্যাদাপূর্ণ মজুরি এবং মজুরি বোর্ড যাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, সেটি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী স্থায়ী শ্রম সংস্কার কমিশন ও জাতীয় সংলাপ ফোরাম গঠন করতে হবে।

৪. শ্রমিক সংজ্ঞা সম্প্রসারণ, নিশ্চিতকরণ: সকল নাগরিকের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার সংগঠন করা ও মতপ্রকাশ। এটি নিশ্চিত করতে আইনে শ্রমিকের সংজ্ঞা সম্প্রসারণ ও ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত ও সকল বাধা দূরীকরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকর উদ্যোগ আমাদের আকাঙ্ক্ষিত। আউটসোর্সিং, গৃহকর্মী, দৈনিক মজুরি ভিত্তিক শ্রমিকসহ সকল শ্রমিককে শ্রমিকের সংজ্ঞায় যুক্ত করতে হবে।

৫. মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার: সকল শ্রমিকই তার ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করতে চায় যাতে রাষ্ট্রীয় নানান সুরক্ষা পায়। কিন্তু বিদ্যমান আইনে ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের বেশ কিছু অসম্ভব শর্তের সমাহার—নানা বাধা ও হয়রানি হয়ে এবং রেজিস্ট্রেশন না পাওয়ার কারণ হিসেবে জারি আছে। রেজিস্ট্রেশন একটি রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, বিশেষত গত ১৫ বছরে। মালিক ও সরকারের আনুকূল্য, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যাপক আর্থিক প্রভাব কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা রানা প্লাজার মতো ঘটনার কাল ছাড়া ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন বা আইন পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের পূর্বে অরেজিস্ট্রিকৃতদের সুরক্ষার বদলে ধারা ২৯৯ সংশোধনী প্রস্তাবনায় এখনো দণ্ডের বিধান আছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাব সংশোধন করে অরেজিস্ট্রিকৃত ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রেশন চলাকালীন সময়ে/রেজিস্ট্রেশনের পূর্বে পূর্ণ সুরক্ষার আইন-বিধি প্রণয়ন জরুরি। এবং ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের শর্ত শিথিল করা আবশ্যক। এ্রর জন্য নিম্নোক্ত পারস্পরিক সম্পর্কিত ধারাগুলো সংশোধন প্রয়োজন।

৫ক. ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা:

ধারা ১৭৯-এ ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের শর্ত শিথিল করতে হবে। বাংলাদেশে ২০ জনের নীচে যে কোন প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠান পুঞ্জ এবং ২০-এর অধিক শ্রমিক হলে প্রতিষ্ঠান বলা হয়। লাইসেন্স করা ৫৫ হাজার কারখানার মধ্যে ৩৬ হাজারই ৫০ এর নীচে শ্রমিকের! এই সার্বিক পরিস্থিতে আমরা শতকরা বদলে সংখ্যায় রেজিস্ট্রেশন শর্ত আনার আহবান করছি। সরকার ও মালিকের পক্ষ থেকে স্ল্যাবের মাধ্যমে এটি নির্ধারনের কথা বলা হয়েছে। আমরা স্পষ্ট বলতে চাই স্ল্যাবের মাধ্যমে যদি বিদ্যমান আইনের চেয়ে পরিমাণে বেশি শ্রমিক নিয়ে ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করতে হয়তবে তাতে শ্রমিক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। দেশে বিদেশে সর্বত্র এই আইন সমালোচিত হবে। অবশ্যই বিদ্যমান আইনের দেয় পরিমাণের চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে ইউনিয়ন করার সুযোগ তৈরি করাই নতুন বিএলএর লক্ষ্য হওয়া আামাদের কাঙ্ক্ষিত।

৫খ. ইউনিয়নের সীমা ও নির্বাচন প্রসঙ্গ:

একটি প্রতিষ্ঠানে ৫টি ইউনিয়নের সীমায় আটকে না রাখা এবং এর সমস্যা-সুবিধার দিক পুনর্বার সতর্কতার সাথে বিবেচনা জরুরি। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বিষয়ক ১৭৮, ১৭৯, ১৯০, ২৯৯ ধারাগুলোর বিষয়ে মনোযোগ রেখে সংশোধন করা জরুরি। ধারাগুলোর ক্রমবিন্যাস ও সন্নিবেশের ধারাবাহিকতা থাকা দরকার, যাতে শ্রম আইন পড়তে ও বুঝতে গোলক ধাঁধায় না পড়ে একজন শ্রমিক নিজ অধিকার সম্পর্কে সহজে অবগত ও সচেতন হতে পারেন।

কোনো ইউনিয়ন নির্বাচন তদারকিতে কোন প্রকার সরকারি বা ক্ষমতাশীলদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে ধারা ৩১৭(৪)ঘ এর শ্রম পরিচালকের দায়িত্বের সীমাকে সীমিত করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে ৩১৭(৪/ঘ) পরিবর্তন করে কেবলমাত্র ইউনিয়নের অনুরোধে শ্রম পরিচালক নির্বাচন পরিদর্শন করতে পারবেন, এই বিধানে আইন নির্ধারণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

৫.গ ধারা ২০২ যৌথ দরকষাকষি প্রসঙ্গ: যৌথ দরকষাকষির প্রতিনিধি নির্ধারণে বিদ্যমান আইনই বহাল থাকা প্রয়োজন। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে একটি ইউনিয়ন থাকলে সেটিই যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হওয়া দরকার। যৌথ দরকষাকষি প্রতিনিধি নির্ধারণে (সিবিএ) ৫০%+১ এর পরিবর্তে সর্বোচ্চ ভোট সাপেক্ষে থাকা জরুরি। ধারা ২৬-এ শ্রমিক টার্মিনেশনের অপব্যবহার ও অসদাচরণ রোধে আইনি বিধান প্রয়োজন।

৬. যৌন হয়রানি ও সহিংসতাহীন মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ: শ্রম আইনে সহিংসতা, হয়রানি, লিঙ্গভিত্তিক হয়রানি ও যৌন হয়রানির সংজ্ঞা নতুন ধারা হিসেবে সরকারের প্রস্তাব ধারা ২-এর ঢ/৭৭ক, ণ (৭৮)২ (ত)(৭৯)ও ৮০ নতুন সংযুক্তি (এনটিসিসি বৈঠকে) শ্রম পরিবেশে একটি নতুন মাইলফলক হবে বলে আমরা মনে করি। শ্রমিক আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণে পথ দেখাবে এই সংযুক্তি।

কিন্তু বিদ্যমান আইনে ধারা ৩৩২-এর নারীর প্রতি আচরণ এর সাথে নতুন ধারা ধারা ২-এর ঢ/৭৭ক, ণ(৭৮)২ (ত)(৭৯)ও ৮০ এর “সহিংসতা ও হয়রানি, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও হয়রানি এবং যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞা বিষয়ক (প্রস্তাবনা ক্রমিক ১৮/১৯/২০) প্রস্তাব সঙ্গতিপূর্ণ ও পুনরাবৃত্তিপূর্ণ। এক্ষেত্রে এ দুটি ধারা একত্রিত করে সংশোধন জরুরি।

৬ক. ধারা:৩৩২: ভাষা অবশ্যই পরিবর্ত করতে হবে ও নারীর মর্যাদহানীকর করা যাবে না: নারীর প্রতি আচরন এর ২-এ অশ্লীল, অভদ্রোচিত, শালীনতা এবং সম্ভ্রম শব্দ আপত্তিকর, অস্পষ্ট ও অমর্যাদাকর। এর পরিবর্তন বিবেচনা প্রয়োজনীয়।

এই পরিবর্তেনের কারণ নারীর প্রতি আচরণে অভদ্র, অশ্লীল, অশালীন শব্দ ব্যবহারে আচরণের ক্রটি স্পষ্ট হয় না। অশ্লীল, শালীনতা, অভদ্রচিত শব্দর কোন স্পষ্টা নাই। সর্বোপরি সম্ভ্রম এর সমার্থক শব্দ মর্যাদা, সম্মান, গৌরব ইত্যাদি। নারীর প্রতি ত্রুটিপূর্ণ বা যৌন হয়রানিমূলক আচরণকারীকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নারীর সম্মান অপরের ক্রটিপূর্ণ আচরণে হানি ঘটে না। নারীর সম্ভ্রম শব্দটি পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটায়। ১৯৭১ সাল এর থেকে আমরা নারীর ধর্ষন, হয়রানীকে ইজ্জত, সম্ভ্রম, সম্মান হারানোর সাথে তুলনা করেছে। যার প্রতিফলন শ্রম আইনেও আছে। নারীর উপর কেউ ধর্ষন, হয়রানীকে যৌন নিপীড়ন করলে কোনভাবেই নারীর নয় নিপীড়কের সম্মান নাই হয়। ফলে এ ধরনের ভাষা সমাজের নারী বিদ্বেষী ধারনাকে পুনরুৎপাদন করে।

মুল আইন: “৩৩২: কোন প্রতিষ্ঠানের কোন কাজে কোন মহিলা নিযুক্ত থাকলে, তিনি যে পদমর্যাদারই হোক না কেন, তার প্রতি উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য কেহ এমন কোন আচরণ করিতে পারিবেন না যা অশ্লীল কিংবা অভদ্রচিত বলিয়া গণ্য হইতে পারে, কিংবা যাহা উক্ত নারী শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী।’’

এইখানে পরিবর্তন প্রস্তাব:

কোন প্রতিষ্ঠানের কোন কাজে কোন নারী নিযুক্ত থাকলে, তিনি যে পদমর্যাদারই হোক না কেন, তার প্রতি উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য কেহ এমন কোন আচরণ করিতে পারিবেন না যা হয়রানীমূলক, কিংবা যৌননিপীড়ন নির্যাতন বলিয়া গণ্য হইতে পারে, কিংবা যাহা উক্ত নারী কর্মপরিবেশ ও নাগরিক মর্যাদার হুমকীস্বরুপ ও পরিপন্থী।’’ নারীর প্রতি আচরণ বিষয়ে যে কোন পরিবর্তন নারী মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও নারী আন্দোলনের নেতৃত্বদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে চূড়ান্ত করা যায়।

৬খ. যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও অভিযোগ নিস্পতি: যৌন নিপীড়ন, সহিংসতার সংজ্ঞা নিশ্চিত করতে হবে। এবং অভিযোগ নিরসনে হাই কোর্টের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করা যাবে না।

হাইকোর্টের নির্দেশনায় সুনির্দিষ্টভাবে ৩টা বিষয় আছে: ১) কমিটির ন্যূনতম ৫ সদস্য থাকতে হবে, ২) কমিটি প্রধান নারী হবেন (সম্ভব হলে), এবং ৩) কমিটিতে অন্তত ২জন বহিঃসদস্য থাকতে হবে, সম্ভব হলে এমন সংগঠনের প্রতিনিধি যারা নারী নির্যাতন নিয়ে কাজ করে।

ফলে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনযায়ী কমিটি সকল শ্রমিক কারখানা প্রতিষ্টানে করতে হবে। কমিটি নারী-পুরুষ সদস্য রাখতে হবে, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং অবশ্যই নারী বিষয় বিশেষজ্ঞকে প্রতিষ্ঠানের বাইরের ব্যক্তি সদস্য হিসাবে রাখতে হবে।

৭. প্রসূতিকালীন ছুটি, পিতৃত্বকালীন ছুটি ও চা শ্রমিক প্রসঙ্গ: বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারাসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৬ মাস সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও শ্রমিকদের বেলায় সেটি ভিন্ন ও বৈষম্যমূলক। ধারা ১১৭-তে সংশোধনী প্রস্তাবে মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি “(ঘ) প্রসূতিকালীন ছুটি অনধিক ১২০ (একশত বিশ) দিন;” করার কথা আছে। কিন্তু আমরা মনে করি শ্রম সংস্কার কমিশনের সামগ্রিক প্রতিফলন সর্বজনীন সুরক্ষা বিবেচনায় প্রসুতিকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি নির্ধারণ করা যেতে পারে। শ্রম সংস্কার কমিশন মতে, সকল নারীর মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা সবেতন ৬ মাস ছুটির উদ্যোগ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারের সহায়তা প্রদান ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কিম করতে হবে। প্রসুতিকালীন ছুটির সুবিধা প্রাপ্তির গণনায় ফাঁক রেখে শ্রমিককে ক্ষতিগ্রস্থ করা যাবে না। চা শ্রমিকদের আর সকল শ্রমিকদের মতো ছুটি ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিতে আইনি সংশোষধন জরুরি।

৮. শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরে জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনীয়ি উদ্যাগ নিয়ে এই সকল কাজকে আধুনিকায়ন (ডিজিটালাইজড) করতে হবে এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিয়িমত রাখতে হবে। একইসাথে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন ও লাইসেন্স নবায়ন, ওয়ান স্পট সার্ভিস: সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। প্রতিবছর কল কারখানা, শিলপপ্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স নিয়মিতভাবে নবায়ন করতে হবে।না শ্রমিক ও মালিকদের সকল কাজ যেমন রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স নবায়ন, সংযুক্ত বিভিন্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে যুক্ত। ফলে শ্রমিক ও মালিক উভয়কে দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়তে হয়, আর্থিক ক্ষতি ও দুর্নীতিপরায়ন ১৫ বছরে ব্যবস্থায় আটকে থাকতে হয়েছে। তাই লাইসেন্স, রেজিস্ট্রশন ইত্যাদির আবেদন ও নবায়ন ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা একটি একক স্থান বা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে করার উদ্যোগ নিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। যাতে একটি জায়গা থেকেই শ্রমিক-মালিক-সরকার সুবিধাগুলো পেতে পারে।

৯. শ্রমিকের প্রাপ্য লভ্যাংশ, শ্রমিককল্যান তহবিল এবং সেন্ট্রাল ফান্ড প্রসঙ্গ: শ্রমিকের প্রাপ্য লভ্যাংশ, শ্রমিককল্যান তহবিল এবং সেন্ট্রাল ফান্ড প্রসঙ্গ: যথাযথ-স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবহার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন প্রয়োজনীয়। শ্রম আইনের পঞ্চদশ অধ্যায়: কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ অধ্যায়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের সকল পাওনা ব্যাংকিং পদ্ধতিতে দিতে হবে।

১০. শ্রমিক ইতিহাস-ঐতিহাসিক স্থান সুরক্ষা ও স্মৃতি সৌধ গঠন: শ্রমিক ইতিহাস-ঐতিহাসিক স্থান সুরক্ষা, স্মৃতি সৌধ, যাদুঘর-গবেষণাগার গঠনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া, পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম, শিক্ষা কোর্সে শ্রম বিষয় [লেবার স্টাডিজ] মর্যাদাপূর্ণভাবে উত্থাপন ও যুক্ত করা দরকার। শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রম বিষয়ক পাঠের পাশাপাশি মাঠের কাজের যুক্ততা রাখা প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানে ও শ্রমিক আন্দোলনে নিহত শ্রমিকদের নামে বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মাণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

১১ আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়: শ্রম আইন সংশোধন, শ্রম খাত সংস্কারে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় বৃদ্ধি এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তরসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

১১. অনলাইন ব্যবস্থাকে জোরদার ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা: রেজিস্ট্রেশনসহ শ্রমিকের অভিযোগ সমাধান, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে অনলাইন ব্যবস্থাকেও জোরদার করা জরুরি। শ্রমিকের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। কেবল মাত্র ক্ষমতার সুবিধাবোভোগি ও মালিকদের ইচ্ছায় নয় শ্যমিক সংগঠনগুলো চাহিদা আবেদনের ভিত্তিতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ সুবিধা দিতে হবে। প্রয়োজনে শ্রমিক-মালিক-সরকার ৩ পক্ষকে আইন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষন দিতে হবে।

১২. শ্রমিকদের বেতন-মজুরি-সুবিধা ব্যাংকিং পদ্ধতিতে প্রণয়ন করতে হবে: শ্রমিকদের বেতন-মজুরি-ক্ষতিপুরণ, ছাটাই, টার্মিনেশনসহ অণ্যান্য সুবিধা আ আর্থিক প্রাপ্তি কোনভাবে নগদ বা কোন শ্রমিকস্বার্থবিরোধী সংগঠন, এলাকার ক্ষমাবান (চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রীয়র ব্যক্তিগ কার্যালয়ে বা বাসায় করা যাবে না। বা গোপন করা যাবে না। শ্রমিকের প্রাপ্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যাংকিং পদ্ধতিতে প্রণয়ন করতে হবে। যাতে কোন সুবিধাভোগীরা শ্রমিকদের ক্ষতি করতে না পারে।

১৩: সামজিক সুরক্ষার সকল সুবিধার তথ্য শ্রমিকদের কাছে থাকতে হবে। হট লাইনের মাধ্যমে এবঙ সকল শ্রমিক সংগঠনকে জানাতে হবে। সামাজিক সুরক্ষার নানা অনুদান ও সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা আশা করি সরকার শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ চুড়ান্ত করার জন্য তার যথাযথ সতর্ক বিবেচনা ও মনোযোগ রাখবে। ইতিমধ্যে টিসিসি (জাতীয় পরামর্শ পরিষদ) ১২৪টি ধারা সংশোধনে বাংরাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের আজকের আলাচনার বিবেচ্য দিকগুলো বিশেষভাবে নজর দিবেন। আরা এই লিখিত বক্তব্যটি মাননীন প্রধান উপদেষ্টা, শ্রম উপদেষ্টা, উপদেষ্টা মন্ডলিসহ সংশ্লিষ্টদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি সংবাদ মাধ্যম সেইকাজে আমাদের সহযোগিতা করবে। এবং অন্তবরর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামন্ডলী এ বিষয়ে আমাদের ১৩টি প্রস্তাবনা চুড়ান্ত করার সময় বিশেষ বিবেচনা করবেন এবং খসড়া অধ্যাদেশ চুড়ান্ত করনে বেবেচনা করবেন।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com