বন্ধুত্বের চুক্তি নাকি স্বাধীনতার ক্ষতি? বিতর্কে বাংলাদেশের তথাকথিত ‘দাসত্বের চুক্তি’

বন্ধুত্বের চুক্তি নাকি স্বাধীনতার ক্ষতি? বিতর্কে বাংলাদেশের তথাকথিত ‘দাসত্বের চুক্তি’
প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত পরিভাষা হলো- ‘দাসত্বের চুক্তি’। যদিও বাস্তবে এই নামে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই, তবু রাজনৈতিক বক্তব্য ও বিশ্লেষণে এই শব্দটি বারবার উঠে আসে। মূলত ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দো-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তিকে ঘিরেই এই বিতর্কের জন্ম।

India.com-এ প্রকাশিত এক ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘Treaty of Slavery’ শব্দটি ছিল রাজনৈতিক ও বাগ্মিতামূলক একটি অভিব্যক্তি, যা স্বাধীনতার পর বিরোধী দল ও কিছু জাতীয়তাবাদী লেখক ব্যবহার করতে শুরু করেন।

তারা বোঝাতে চেয়েছেন- “চুক্তিটি বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল”।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়, অবকাঠামোগত ধ্বংস এবং নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তার ফলে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ও কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তির পথে অগ্রসর হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ, নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটির মেয়াদ নির্ধারিত ছিল ২৫ বছর।

চুক্তির প্রধান বিষয়বস্তু-

চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত একাধিক বিষয়ে পারস্পরিক অঙ্গীকার করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

  • একে অপরের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান

  • আগ্রাসন ও হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা

  • শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান

  • অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ

  • বহিরাগত আগ্রাসনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতা

স্বাক্ষরের সময় এই চুক্তিকে দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সংহতি জোরদারের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল।

কেন ‘দাসত্বের চুক্তি’ বিতর্ক-

পরবর্তী সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও কিছু বিশ্লেষকের পক্ষ থেকে চুক্তিটির তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তাদের অভিযোগ ছিল-

  • চুক্তিটি ভারতের জন্য অতিরিক্ত কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করেছে

  • বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির স্বাধীনতা সীমিত হয়েছে

  • একটি নবজাত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে নির্ভরশীলতার ইঙ্গিত দিয়েছে

এই সমালোচনার প্রেক্ষিতেই ‘দাসত্বের চুক্তি’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি রাজনীতিতে ভারতবিরোধী বক্তব্য জোরদার হলে এই শব্দবন্ধ আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সমর্থকদের পাল্টা যুক্তি-

অন্যদিকে, চুক্তির সমর্থকরা এই পরিভাষাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন। তাদের মতে, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় একটি কূটনৈতিক চুক্তি। অনেক ইতিহাসবিদ একে শীতল যুদ্ধকালীন সময়ের একটি সাধারণ দ্বিপাক্ষিক মৈত্রী চুক্তি হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন, দাসত্ব বা আনুগত্যের দলিল হিসেবে নয়।

চুক্তির পরিসমাপ্তি, বিতর্কের স্থায়িত্ব-

চুক্তিটি নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালে আর নবায়ন করা হয়নি। তবে রাজনৈতিক ভাষ্য ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সংক্রান্ত আলোচনায় ‘দাসত্বের চুক্তি’ শব্দটি এখনো ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে যখন দ্বিপাক্ষিক কোনো নতুন সমঝোতা বা চুক্তি সামনে আসে।

India.com-এর প্রতিবেদনের মতে, এই শব্দবন্ধ মূলত ঐতিহাসিক বাস্তবতার চেয়ে রাজনৈতিক বর্ণনা ও মতাদর্শগত অবস্থানকেই বেশি প্রতিফলিত করে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com