নির্বাচনী সংস্কার: কমিশনের ক্ষমতা কতটা কার্যকর হচ্ছে?

নির্বাচনী সংস্কার: কমিশনের ক্ষমতা কতটা কার্যকর হচ্ছে?
প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘নির্বাচনী সংস্কার’ শব্দযুগল বহুদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রে। প্রায় প্রতিটি নির্বাচন ঘিরেই প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) কতটা স্বাধীন, তার ক্ষমতা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, আর সংস্কারের ঘোষণাগুলো আদৌ কতখানি মাঠপর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে কেবল আইন বা কাঠামোর দিকে তাকালেই চলবে না; দেখতে হবে রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রশাসনিক আচরণ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সামগ্রিক চিত্র।

সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

প্রতিটি নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই সংস্কারের আশ্বাস দেয়-স্বচ্ছ ভোট, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, কালো টাকার প্রভাব কমানো, আচরণবিধির কঠোর প্রয়োগ। আইন অনুযায়ী কমিশনের হাতে রয়েছে নির্বাচন পরিচালনা, তফসিল ঘোষণা, আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ, এমনকি প্রয়োজনে ভোট স্থগিত করার ক্ষমতাও। কাগজে-কলমে এসব ক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হলেও প্রশ্ন হলো-এই ক্ষমতা প্রয়োগের স্বাধীনতা ও সাহস কতটা রয়েছে?

বাস্তবে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে দুর্বল হয়ে যায়। ফলে সংস্কার থেকে যায় মূলত নীতিগত ঘোষণায় সীমাবদ্ধ।

ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা কোথায়?

নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কার্যকর না হওয়ার পেছনে কয়েকটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে-

প্রথমত, প্রশাসনিক নির্ভরশীলতা। মাঠপর্যায়ের প্রশাসন- ডিসি, এসপি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট- সবাই কার্যত সরকারের অধীন। নির্বাচন কমিশন নির্দেশ দিলেও বাস্তব প্রয়োগে প্রশাসনিক অনীহা বা দ্বৈত আনুগত্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাব। শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে কমিশন প্রায়ই পিছিয়ে যায়। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে বড় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা খুব কমই নেওয়া হয়, যা কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ায়।

তৃতীয়ত, আইনের সীমা ও প্রয়োগের দুর্বলতা। বিদ্যমান নির্বাচন আইন কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দিলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় তা অনেক সময় অপর্যাপ্ত বা দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না।

সংস্কারের আলোচনায় ইভিএম ও প্রযুক্তি

নির্বাচনী সংস্কারের বড় অংশজুড়ে রয়েছে ইভিএম ও প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তিকে স্বচ্ছতার মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা হলেও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে কারিগরি যুক্তি দেওয়া হলেও, আস্থার সংকট কাটাতে রাজনৈতিক সংলাপ ও স্বাধীন অডিটের ঘাটতি স্পষ্ট। এখানে কমিশনের ক্ষমতার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন।

গণতন্ত্রে কমিশনের ভূমিকা

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন কেবল একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার প্রধান অভিভাবক। কমিশনের শক্তি আসে শুধু আইনি ক্ষমতা থেকে নয়, আসে তার নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা ও নৈতিক অবস্থান থেকে। যখন কমিশন বিতর্কিত পরিস্থিতিতে আপসহীন অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়, তখন তার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাও অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচন কমিশন কার্যকর হয়েছে কারণ সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম কিছু নিয়মে একমত হয়েছে। বাংলাদেশে সেই ঐকমত্যের অভাবই কমিশনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এখানে সংস্কার প্রায়ই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কাঠামোগত পরিবর্তনে সীমাবদ্ধ থাকে, নিচ থেকে আস্থার ভিত্তি তৈরি হয় না।

সামনে পথ কী?

নির্বাচনী সংস্কারকে কার্যকর করতে হলে কমিশনের ক্ষমতা কেবল বাড়ালেই হবে না; প্রয়োজন-

  • প্রশাসনের ওপর কমিশনের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা

  • আচরণবিধি ভঙ্গের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ও সমান প্রয়োগ

  • রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ন্যূনতম আস্থাভিত্তিক সংলাপ

  • কমিশনের সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি

উপসংহার

নির্বাচনী সংস্কার প্রশ্নে মূল সংকট ক্ষমতার অভাব নয়, বরং ক্ষমতা প্রয়োগের পরিবেশের অভাব। নির্বাচন কমিশনের হাতে আইনগত ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু সেই ক্ষমতাকে কার্যকর করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক সহযোগিতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রয়োজন—তা এখনো অপর্যাপ্ত। যতদিন এই তিনের সমন্বয় না ঘটবে, ততদিন নির্বাচনী সংস্কার থাকবে আলোচনার শিরোনামে, বাস্তবতার কেন্দ্রে নয়।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com