

ছবিঃ সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে মঙ্গল শোভাযাত্রার গুরুত্ব অত্যন্ত বিশেষ। এটি শুধু বাংলা নববর্ষ উদযাপনের একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। তবে, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা মূলত এর রাজনৈতিক বার্তা ও সাংস্কৃতিক উপাদানের সংমিশ্রণ নিয়ে। এর ফলে নতুন প্রশ্ন উঠছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক উদযাপন হওয়া উচিত, নাকি এটি রাজনৈতিক বার্তা প্রদান করার একটি মাধ্যম হয়ে উঠছে?
১. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং তার গুরুত্ব
মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তি এবং এর উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল—বাংলা সংস্কৃতির উদযাপন। ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষ উদযাপনের একটি বড় অংশ হয়ে ওঠে। এতে অংশগ্রহণ করে নানা ধরনের শিল্পকর্ম, মুখোশ, প্রতিকৃতি এবং বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদান। এমন আয়োজন দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ২০১৬ সালে, যা শোভাযাত্রার গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে।
এমন একটি ঐতিহ্যকে রাজনৈতিক বার্তার সাথে সংযুক্ত করা কি উপযুক্ত? এর বিপরীতে কিছু প্রশ্নও উঠে আসছে, বিশেষ করে দেশের শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, এবং ছাত্র-শিক্ষক সমাজের মধ্যে।
২. রাজনৈতিক বার্তা ও তার বিপদ
এই বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে "নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান"। এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা, যা দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও গত বছরের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বার্তার সংমিশ্রণটি সামাজিকভাবে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
এটি প্রশ্ন তুলছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা যে উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল—বাঙালির ঐতিহ্যকে উদযাপন—সে উদ্দেশ্য এখনও কতটা বজায় রাখা যাচ্ছে? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। ঐতিহ্যকে একটি রাজনৈতিক অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করলে, সে ঐতিহ্য সাধারণ জনগণের কাছে আদর্শ কিংবা সরল আনন্দের জায়গা থেকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। এতে সামাজিক ঐক্য এবং জনগণের অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি হতে পারে, কারণ সবাই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একমত নাও হতে পারে।
৩. শিক্ষার্থীদের বর্জন এবং এর বিশ্লেষণ
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বর্জন। তারা অভিযোগ করেছেন যে এবারের আয়োজনটি রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে এবং তাদের আগের ঐতিহ্যবিরোধী। এই বিষয়টি প্রশ্ন তুলছে—এটি কি শুধু সাংস্কৃতিক উদযাপন হওয়া উচিত, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত?
শিক্ষার্থীরা যেভাবে বর্জন করেছেন, তা অবশ্যই ভাবনায় রাখতে হবে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এবারের আয়োজনের সঙ্গে কোনো পূর্ব আলোচনা বা সম্মতি ছিল না, এবং এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে। সেইসাথে, শোভাযাত্রার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং সবকিছু কিছু নির্বাচিত গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তে নির্ধারণ হয়েছে। এতে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে বাইরে রাখার অনুভূতি পেয়েছে। এটি একটি সতর্কতা, যে যখন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, তখন সেই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণীর মানুষের সমর্থন পাওয়া কঠিন হতে পারে।
৪. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক বার্তা বিভাজন বা ঐক্য?
এখন আসা যাক মূল প্রশ্নে, "রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে সাংস্কৃতিক উদযাপন করা কি আদৌ সঠিক?" যেহেতু মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম বড় উৎসব, যেখানে সকল শ্রেণীর মানুষ—জাতি, ধর্ম, বয়স নির্বিশেষে—একত্রিত হয়ে আনন্দ উদযাপন করেন, সেহেতু এই ধরনের আয়োজন যদি একপক্ষীয় রাজনৈতিক বার্তা প্রদান করতে শুরু করে, তবে তা ঐক্যকে বিভাজনে পরিণত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শোভাযাত্রার মাধ্যমে যে "ফ্যাসিবাদের অবসান" প্রতিপাদ্য তুলে ধরা হচ্ছে, তা এক শ্রেণীর মানুষের কাছে ইতিবাচক হতে পারে, কিন্তু অন্য শ্রেণী, বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্কিত, তারা এটি নাকচও করতে পারেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক বার্তা দেয়ার মাধ্যমে বিভাজন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, কারণ সকলের রাজনৈতিক মতাদর্শ একরকম নয়। তা ছাড়া, সংস্কৃতির উদযাপন যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তা সেই অনুষ্ঠানের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। একটি সাংস্কৃতিক উদযাপন, বিশেষ করে এমন একটি ঐতিহ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান, একের পর এক রাজনৈতিক সংকট এবং দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত রাখা উচিত।
৫. শেষ কথা
যদিও মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, তবে সেটি যদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গণমানুষের আনন্দের মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তবে তা সমস্যা তৈরি করবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের ঐক্য এবং আনন্দ, যা সামাজিকভাবে সমৃদ্ধি এনে দেয়। রাজনৈতিক বার্তা যোগ করলে এই উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিশেষত যখন তা সকল শ্রেণী ও গোষ্ঠীর জন্য এক ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করে।
অতএব, মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য যদি সত্যিকার অর্থে দেশের ঐতিহ্য উদযাপন করা হয়, তবে রাজনৈতিক ইস্যুগুলি অবশ্যই আলাদা থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মেশালে, তা ঐতিহ্যের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।