রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণের পথে বাধা

রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণের পথে বাধা
প্রকাশিত

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কিছু সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, নির্বাহী প্রধানের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা, এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। তবে এসব সংস্কারের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বিএনপির আপত্তির কারণে।

প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদকাল নির্ধারণে মতবিরোধ

প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সীমিত করার প্রস্তাবনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রস্তাবিত সংস্কার অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিএনপির আপত্তি হলো, যদি কেউ দুই মেয়াদ পূর্ণ করেন, তবে পরবর্তী জীবনে কখনোই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এমন বিধান অযৌক্তিক। দলটি চায়, টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ যেন না থাকে, তবে এক মেয়াদ বিরতির পর পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সীমিত না থাকলে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখা দিতে পারে। যা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে নির্বাচন ব্যবস্থায় অনিয়ম ও একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিশ্বের অনেক দেশে দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নেই, যা গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ পৃথক করার প্রয়োজনীয়তা

সংস্কার কমিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ পৃথক করা। এর পেছনের যুক্তি হলো, দলীয় প্রধান একইসঙ্গে সরকারের প্রধান হলে প্রশাসন ও দলের স্বার্থ প্রায়শই এক হয়ে যায়, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য হুমকিস্বরূপ। বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে এবং বলেছে, এটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রধান থাকাটা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে, যা গণতন্ত্রের বিকাশে অন্তরায়।

সরকারের মেয়াদকাল: পাঁচ বছর নাকি চার বছর?

সংস্কার কমিশন সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করার প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তি হলো, দীর্ঘ মেয়াদের কারণে যদি কোনো সরকার ব্যর্থ হয়, তবে জনগণকে তাদের পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। কিন্তু বিএনপির দাবি, পাঁচ বছরই একটি সরকার পরিচালনার জন্য উপযুক্ত সময়। তাদের মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চার বছর যথেষ্ট নয় এবং এটি হঠাৎ পরিবর্তন করা ঠিক হবে না।

বিশ্লেষকদের মতে, চার বছরের মেয়াদ বিশ্বব্যাপী একটি গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড। দীর্ঘ পাঁচ বছরের শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক সংকটের সম্ভাবনা থাকে। চার বছরের মেয়াদ কার্যকর হলে একটি সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন দ্রুত সম্ভব হবে, যা গণতন্ত্রকে আরও গতিশীল করবে।

গণতান্ত্রিক সংস্কারের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অধিকতর কার্যকর করতে সংস্কার অপরিহার্য। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত ও নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা এসব সংস্কারের বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিএনপির আপত্তির কারণে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার আটকে যেতে পারে, যা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য উদ্বেগের বিষয়।

অতএব, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহিতা এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতা। যদি এসব সংস্কার বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশ একটি আরও কার্যকর ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com