বিটিআরসির আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরাম ভাঙার সিদ্ধান্ত এবং তার প্রভাব

বিটিআরসির আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরাম ভাঙার সিদ্ধান্ত এবং তার প্রভাব
প্রকাশিত

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের ইতিহাসে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) অপারেটর ফোরাম বা আইওএফের ভূমিকা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এই ফোরামটি প্রায় দশ বছর ধরে দেশের আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একচেটিয়া ক্ষমতা ধারণ করেছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আইওএফ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কেবল এক ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের অবসান ঘটানোই নয়, বরং এটি টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তবে এই পদক্ষেপের বিশ্লেষণ করতে গেলে কিছু গভীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রশ্ন ওঠে, যা একে একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ দাবি করে। এই লেখায় আমরা আইওএফ সিন্ডিকেটের কার্যক্রম, এর প্রভাব, বিটিআরসির পদক্ষেপের সম্ভাব্য ফলাফল এবং ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফোনকল আনার ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি নতুন রূপান্তর ঘটে। যখন দেশে ইন্টারনেট প্রবৃদ্ধি ছিল না এবং ফোনকলই ছিল আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মূল মাধ্যম, তখন আন্তর্জাতিক কলের আদান-প্রদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে আইজিডব্লিউ অপারেটররা আন্তর্জাতিক কল আনার মাধ্যমে তাদের ব্যবসা গড়ে তোলে।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি নতুন নিয়ম চালু করে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফোনকল আদান-প্রদানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটরকে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু সরকার যখন এ অনুমোদন দেয়, তখন টেলিযোগাযোগ খাতের অভ্যন্তরে এক ধরনের গোপন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে, যার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। এই সিন্ডিকেট মূলত কল টার্মিনেশন রেট বৃদ্ধি করে এবং আন্তর্জাতিক ফোনকলের ব্যবসাকে একচেটিয়া করে তুলে। এর ফলে বৈধ কল কমে গিয়ে অবৈধ ভিওআইপি কলের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর ছিল।

আইওএফ সিন্ডিকেটটি রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ব্যবসায়িক দিক থেকে একদম নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এর মাধ্যমে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছিল এবং গ্রাহকরা বেশি মূল্য পরিশোধ করছিলেন। এমনকি, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কার্যকরীভাবে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়ছিল।

বিটিআরসি যখন আইওএফ সিন্ডিকেট ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তা একদিকে সরকারের রাজস্ব সুরক্ষিত করার এবং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস বলে মনে হচ্ছে। বিটিআরসি ইতিমধ্যে সিন্ডিকেটের কার্যক্রম বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ বিষয়ে একটি নতুন নির্দেশিকা জারি করার কথা জানিয়েছে। এর মাধ্যমে আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, কল টার্মিনেশন রেটের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমানো এবং বৈধ ও অবৈধ কল আদান-প্রদানের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার করা সম্ভব হবে।

এখানে যে বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে, তা হলো, বিটিআরসির সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিদেশি কল আদান-প্রদান ও তার নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেখানে অবৈধ ভিওআইপি কল বেড়ে গিয়েছিল, সেখানে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ পেলে বৈধ কলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, যা সরকারের রাজস্বের জন্য লাভজনক হবে।

তবে, বিটিআরসির এই পদক্ষেপের কার্যকরীতা এবং তার বাস্তবায়ন নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, বিটিআরসি কীভাবে নিশ্চিত করবে যে নতুন ব্যবস্থা বাজারের জন্য কার্যকর হবে এবং কোনো নতুন সিন্ডিকেট সৃষ্টি হবে না? দ্বিতীয়ত, বিটিআরসি কীভাবে নিশ্চিত করবে যে এই পদক্ষেপটি টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে? এবং শেষমেষ, বিটিআরসির নতুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারের রাজস্বে কতটা বৃদ্ধি হবে, তা এখনো অজ্ঞাত।

আইওএফের আরেকটি বিতর্কিত দিক হচ্ছে, মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এমডিএস) যা ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, এমডিএস ফান্ডের প্রায় ৯৫% অর্থ বেক্সিমকোর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, যা মূলত একক প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার কারণে এটি দুর্নীতির জন্ম দেয়। এছাড়া, এই ফান্ডের ব্যবহার নিয়ে যে অস্বচ্ছতা ছিল, তা দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে বিটিআরসি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি পাঠিয়ে তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছে, যা সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

এছাড়া, আইজিডব্লিউ অপারেটরের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা এবং আইওএফের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবের বৃদ্ধি মূলত ব্যবসায়িক পরিবেশের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে ব্যবসায়ী এবং জনগণের মধ্যে অনাস্থা বেড়েছিল, যা এখন বিটিআরসি চাইছে ঠিক করতে।

আইওএফ সিন্ডিকেট ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার এখন একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কলের বাণিজ্য পুনঃস্থাপন করা অনেক বেশি কঠিন কাজ। বিটিআরসি যদি সফলভাবে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে তা সরকারের রাজস্ব বাড়াতে সাহায্য করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।

তবে, ভবিষ্যতে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসতে পারে, তা হলো-আইজিডব্লিউ অপারেটরের সঠিক নিয়ন্ত্রণ, নতুন সিন্ডিকেটের সৃষ্টি বন্ধ করা এবং রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা। একদিকে যেখানে সরকারের কাছে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে চায়, সেখানে খাতের অন্যান্য অংশের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করাও গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরাম সিন্ডিকেট ভাঙার বিটিআরসির সিদ্ধান্তটি দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত পদক্ষেপ। তবে, এটি যদি কার্যকরীভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে এর ফলে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক কল ব্যবসার সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা এবং খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারের পরিকল্পনা, টেলিযোগাযোগ খাতের অবকাঠামো এবং খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতার উপর।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com