খালেদা জিয়া, এক আপোষহীনতার নাম হয়ে ওঠার গল্প

খালেদা জিয়া, এক আপোষহীনতার নাম হয়ে ওঠার গল্প
প্রকাশিত

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেত্রী খালেদা জিয়া আর নেই। মঙ্গলবার দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮০ বছর।

তার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি (বিএনপি) জানিয়েছে, দীর্ঘ রোগভোগের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে দলটি জানায়, খালেদা জিয়া লিভারের জটিল রোগ (অ্যাডভান্সড সিরোসিস), বাত, ডায়াবেটিসসহ বুকে ও হৃদ্‌যন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন।

চিকিৎসার জন্য তিনি ২০২৫ সালের শুরুতে লন্ডনে যান এবং সেখানে চার মাস অবস্থানের পর দেশে ফিরে আসেন।

২০০৬ সালের পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকলেও এবং কয়েক বছর কারাবন্দি কিংবা গৃহবন্দি অবস্থায় থাকলেও খালেদা জিয়া ও তার নেতৃত্বাধীন মধ্যপন্থী বিএনপি দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীর সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম ছিল।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকেই এগিয়ে থাকা দল হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান (৬০) প্রায় ১৭ বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে গত সপ্তাহে দেশে ফেরেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন এক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এই সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তক মুহাম্মদ ইউনূস।

চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ছাত্র আন্দোলনে প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের দায়ে শেখ হাসিনাকে অনুপস্থিত অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।

ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক উত্থান

খালেদা জিয়া ছিলেন স্বভাবগতভাবে লাজুক ও পরিবারকেন্দ্রিক। তিনি মূলত তার দুই সন্তানকে বড় করে তোলাতেই মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে তার স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হলে তার জীবন নতুন মোড় নেয়।

এর তিন বছর পর তিনি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং “দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার” অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনে গণআন্দোলনে তিনি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে একজোট হন। তবে এই রাজনৈতিক ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

‘ব্যাটলিং বেগমস’

পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে। এই দ্বন্দ্বের কারণে তারা পরিচিত হন ‘ব্যাটলিং বেগমস’ নামে, যেখানে ‘বেগম’ শব্দটি দক্ষিণ এশিয়ায় মর্যাদাসূচক উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সমর্থকদের কাছে খালেদা জিয়া ছিলেন ভদ্র, ঐতিহ্যবাহী এবং পরিমিত বক্তব্যে অভ্যস্ত এক নেত্রী, আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন ও দৃঢ়চেতা। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ছিলেন অনেক বেশি সরব ও আক্রমণাত্মক, এই বৈপরীত্যই তাদের দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তোলে।

রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা ও সংস্কার

১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, যাকে বাংলাদেশের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হয়- খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসেন। এ সময় তিনি দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন লাভ করেন।

এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো গণতান্ত্রিক দেশের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন, এর আগে পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।

তার শাসনামলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগে বাধা শিথিল, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে চালু করা হয়।

আপোষহীন বেগম জিয়া হয়ে ওঠার গল্প-

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনজুড়ে সবচেয়ে স্পষ্ট যে বৈশিষ্ট্যটি ফুটে ওঠে, তা হলো আপোষহীনতা। ক্ষমতা হারানো, কারাবরণ, মামলা–হামলা কিংবা দীর্ঘ অসুস্থতা—কোনো কিছুই তাকে তার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসক এরশাদের পতনে শেখ হাসিনার সঙ্গে একসঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন, প্রয়োজনে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য গড়তেও তিনি পিছপা নন। কিন্তু গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক নীতিগত প্রশ্নে তিনি কখনোই প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটেননি।

২০০৬ সালে সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তাকে কারাগারে পাঠানো হলেও তিনি ‘রাজনীতি ছাড়ার’ বা বিদেশে চলে যাওয়ার কোনো প্রস্তাবে সম্মত হননি। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একের পর এক মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দি ও গৃহবন্দি থাকলেও তিনি নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে আখ্যা দেন এবং কখনো ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা রাজনৈতিক আপসের পথে যাননি।

নির্বাচনী রাজনীতিতেও তার আপোষহীনতার দৃষ্টান্ত স্পষ্ট। অংশগ্রহণমূলক নয়—এমন নির্বাচনকে তিনি বৈধতা দিতে রাজি হননি। তার সিদ্ধান্তেই বিএনপি ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে, যদিও এতে দলটির রাজনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি ছিল। তবুও তিনি বিশ্বাস করতেন, আপস করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র আদায় করাই রাজনৈতিকভাবে সঠিক পথ।

এমনকি গুরুতর অসুস্থতা, গৃহবন্দিত্ব এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থানের সময়ও তিনি দলের নীতিগত অবস্থান বদলাননি। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বহু দূরে থেকেও খালেদা জিয়া ছিলেন প্রতিরোধের রাজনীতির প্রতীক—যেখানে ক্ষমতার লোভ নয়, বরং রাজনৈতিক অবস্থান ও আত্মমর্যাদাই ছিল মুখ্য। এই অনমনীয় মনোভাবই তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন প্রকৃত অর্থেই আপোষহীন নেত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্থায়ী আসনে বসিয়েছে।

পতন, প্রত্যাবর্তন ও বিতর্ক

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও ২০০১ সালে আবারও বিপুল ভোটে ক্ষমতায় ফেরেন। তবে তার দ্বিতীয় মেয়াদে ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদের উত্থান ও দুর্নীতির অভিযোগ সরকারকে চাপে ফেলে।

২০০৪ সালে শেখ হাসিনার এক জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং ৫০০ জনেরও বেশি আহত হন। হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনার জন্য খালেদা জিয়ার সরকার ও তাদের ইসলামি মিত্রদের ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়।

২০১৮ সালে তারেক রহমানকে অনুপস্থিত অবস্থায় এ ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপি এ বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে।

গ্রেপ্তার, মুক্তি ও শেষ সময়

২০০৬ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার মুখে সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়কেই প্রায় এক বছর কারাবন্দি রাখা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তারা মুক্তি পান।

এরপর খালেদা জিয়া আর রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরতে পারেননি। বিএনপি ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলে দুই নেত্রীর বৈরিতা আরও গভীর হয়।

২০১৮ সালে একটি এতিমখানা ট্রাস্টের বিদেশি অনুদানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ কয়েকজন দোষী সাব্যস্ত হন। তিনি এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন।

স্বাস্থ্যগত অবনতির কারণে ২০২০ সালের মার্চে তাকে মানবিক বিবেচনায় গৃহবন্দি করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি মুক্তি পান।

তবে, শারীরিক দূরাবস্থায় আর মাঠের রাজনীতিতে ফেরা হয়নি তাঁর।

২০২৫ সালের শুরুতে দুর্নীতির মামলায় সুপ্রিম কোর্ট খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে খালাস দেন। এর এক মাস আগেই তারেক রহমান ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা মামলাতেও খালাস পান।

সুত্র- রয়টার্স

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com