
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকিং খাত একটি অপরিহার্য স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক অর্থনীতির গতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জনগণের সঞ্চয় সংরক্ষণ, বিনিয়োগ বিস্তার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য। এই খাতকে দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন উচ্চমানের পেশাগত দক্ষতা সম্পন্ন ব্যাংকার, যারা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান IBISWorld–এর মতে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ১০,১৫৩টি এবং এই খাতে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা ৭২ লক্ষেরও বেশি।
বাংলাদেশেও ব্যাংকিং খাতের ব্যাপ্তি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। বর্তমানে দেশে অনুমোদিত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি এবং এই খাতে প্রায় ২ লাখ ৩ হাজার জন জনবল কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপিতে ব্যাংকিং খাতের অবদান প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, যা ৩.৪ শতাংশের সমপরিমাণ।
আধুনিক ব্যাংকিং সেবার পরিধি এখন আর শুধুমাত্র টাকা জমা বা উত্তোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একজন ব্যাংকার এখন একজন আর্থিক পরামর্শদাতা, নীতিনির্ধারক, ঝুঁকি ব্যবস্থাপক, এমনকি একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞও বটে। এই বহুমাত্রিক দায়িত্ব পালনে প্রয়োজন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা।
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রায় ২ লক্ষ ৩ হাজার ৬৯৬ জন জনবল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁদের দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও পেশাগত সততার উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো।
একজন ব্যাংকারের কাজ শুধুমাত্র গ্রাহকের টাকা জমা বা উত্তোলনে সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি একজন আর্থিক পরামর্শদাতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপক, নীতিনির্ধারক এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবার চৌকস ব্যবস্থাপকও।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ও প্রযুক্তিবান্ধব পরিবেশে একজন ব্যাংকারের দক্ষতা যত বেশি পরিপূর্ণ ও সমন্বিত হবে, তাঁর ব্যক্তিগত ও পেশাগত সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি।
এসব দিক বিবেচনা করে একজন আধুনিক ব্যাংকারের মধ্যে কিছু বিশেষ দক্ষতা থাকা অপরিহার্য, যেগুলো তাঁকে শুধু ব্যক্তিগতভাবে সফলই করে না, বরং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এবং সমাজের অগ্রগতিতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে থাকে।
১. আর্থিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাঃ
একজন ব্যাংকারের ভিত্তি গড়ে ওঠে তাঁর আর্থিক বিশ্লেষণ সক্ষমতার উপর। ব্যালেন্স শিট, ইনকাম স্টেটমেন্ট বা ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণের সক্ষমতা ছাড়া ঋণ অনুমোদন, বিনিয়োগ পরিকল্পনা কিংবা ঝুঁকি নিরূপণ কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। বাজার পরিস্থিতি ও অর্থনীতির গতিপথ বিশ্লেষণ করতেও এই জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা এ ব্যাপারগুলোতে অধিকতর ধারণা রাখেন তারা প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। একজন দক্ষ ব্যাংকারের সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া যতটা তথ্যভিত্তিক ও বিশ্লেষণনির্ভর হবে, ততটাই তা প্রতিষ্ঠানকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে।
২. যোগাযোগ ও উপস্থাপনের দক্ষতাঃ
ব্যাংকিং খাতের প্রতিদিনের কাজকর্মে একজন ব্যাংকারকে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়—গ্রাহক, সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধি। তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে স্পষ্টতা, আত্মবিশ্বাস ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখা একজন ব্যাংকারের অপরিহার্য গুণ। এ ছাড়া আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও বিশ্বাস স্থাপনে বিশেষভাবে সহায়ক হয়।
৩. প্রযুক্তিগত দক্ষতাঃ
যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যাংকিং সেবা হয়ে উঠেছে ক্রমশ প্রযুক্তিনির্ভর। এখনকার ব্যাংকারদের শুধু কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার জানা নয়, বরং মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সাইবার সিকিউরিটি ও ডেটা অ্যানালিটিক্সের সাধারণ ধারণাও থাকতে হয়। গ্রাহকের সময় বাঁচাতে, সেবার মান বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়া একটি বড় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা। এই প্রতিযোগিতায় যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনি আরো একটি প্রতিষ্ঠান ও নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন।
৪. সমস্যা সমাধানের সক্ষমতাঃ
ব্যাংকিং পেশায় প্রতিদিনই তৈরি হয় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ— বিনিয়োগকারীদের মুনাফা লাভের সমস্যা, ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি সমস্যা, লেনদেন সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত জটিলতা বা নীতিগত দ্বন্দ্ব। এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং বিশ্লেষণী দক্ষতা। একজন চৌকস ব্যাংকার এমন অসংখ্য সমস্যাকে সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে দেখেন এবং প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি গ্রাহকের আস্থা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন।
৫. সততা ও নৈতিকতাঃ
ব্যাংকিং পেশা একটি আস্থাভিত্তিক পেশা। একজন ব্যাংকারকে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হয় গ্রাহকের অর্থ, ব্যক্তিগত তথ্য এবং সংবেদনশীল দলিলের সঙ্গে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ সততা, স্বচ্ছতা ও পেশাগত নৈতিকতা। একজন নীতিবান ব্যাংকার প্রতিষ্ঠানকে যেমন আইনগত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করেন, তেমনি তার সুনাম ও টেকসই উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
৬. সময় ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলাঃ
ব্যাংকিং খাত সময়নির্ভর ও কাঠামোবদ্ধ, যেখানে অফিসে আসা-যাওয়া বা অফিস খোলা - অফিস বন্ধ করা থেকে শুরু করে প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। একজন ব্যাংকারকে সুশৃঙ্খলভাবে সেগুলো মেনে চলতে হয়। নির্ধারিত সময়ের সাথে কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হয় এবং তা সময়মতো সম্পন্ন করাটাও জরুরি। এই সময়ানুবর্তিতা কেবল ব্যক্তিগত দক্ষতার পরিচায়ক নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কার্যকারিতাও এর ওপর নির্ভর করে।
৭. দলবদ্ধভাবে কাজ করার সক্ষমতাঃ
ব্যাংকিং হলো একটি দলভিত্তিক পেশা, যেখানে প্রতিটি বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। একজন ব্যাংকারের মধ্যে দলগত কাজের মানসিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার মনোভাব না থাকলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করা কঠিন। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান কেবল কার্যকর সেবা প্রদানই করে না, বরং তা কর্মপরিবেশ ও পেশাগত সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করে।
ব্যাংকিং এখন শুধুমাত্র একটি পেশা নয়—এটি একটি নেতৃত্ব, দায়বদ্ধতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের সুযোগ। একজন ব্যাংকারের সাফল্য নির্ধারিত হয় তাঁর আর্থিক জ্ঞান, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, যোগাযোগ কৌশল, নৈতিকতা ও সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার সামর্থ্যের উপর। সঠিকভাবে এসব দক্ষতা অর্জন ও প্রয়োগের মাধ্যমে একজন ব্যাংকার হতে পারেন কেবল একটি প্রতিষ্ঠানেরই নয়, বরং একটি অর্থনীতিরও অন্যতম চালক।
যারা ভবিষ্যতে ব্যাংকিং পেশায় আসতে আগ্রহী, তাঁদেরও উচিত একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি এই গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো অর্জনে আগে থেকেই মনোনিবেশ করা। তাহলে এই গুরুদায়িত্বপূর্ণ পেশায় এসে নিজেদের ক্যারিয়ার উন্নয়নের পথটি মসৃণ করা সহজ হবে।
লেখকঃ
এম এম মাহবুব হাসান
ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক