
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, যার ইতিহাস দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে, বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। দলের অতীতের সাফল্য ও জনগণের প্রতি তার অবদান সত্ত্বেও আজকের সময়ে দলের মধ্যে যে দুর্বলতা ফুটে উঠছে, তা প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক দৃশ্যপট এবং দলীয় কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আসা প্রয়োজন।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ এবং পরবর্তীতে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, একে একে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলো দলের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দোলনগুলোর কারণে সরকার পন্থি আওয়ামী লীগের নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি এবং বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্যই, অতীতে রাজনৈতিক সংকটগুলোতে আওয়ামী লীগ নিজের শক্তি ও দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়েছে, যেমন ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের মতামতকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং এক ধরনের আড়ালে কাজ করা এবং নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে জনগণের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে এবং দলের কর্মীরা এক ধরনের অস্থিরতা ও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।
যেখানে একসময় আওয়ামী লীগ তার আদর্শ এবং নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সেখানে আজকের পরিস্থিতি সেই দলের জন্য এক অস্বস্তিকর চিত্র প্রদর্শন করছে। আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী ও আদর্শনিষ্ঠ কর্মী আজ দলের ভেতরে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। পরিবর্তে, সুবিধাবাদী নেতারা দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থান পাচ্ছেন। তারা দলের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য কাজ করছেন, যার ফলে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় যে দলটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাহায্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের উপর দমনপীড়ন চালানোর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখছে। এমনটি চলতে থাকলে, দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হবে এবং কার্যকর নেতৃবৃন্দ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জনগণের মধ্যে যে বিরোধিতা সৃষ্টি হচ্ছে, তা অবশিষ্ট দলীয় সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
এতদিন ধরে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে শীর্ষ নেতৃত্ব, দলে রাজনৈতিক সমন্বয়ের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রের পথে হাঁটছে। দেশে যখন সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন চলছে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে কিছু শক্তিশালী ব্যক্তির কাছে সমস্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রিত হয়ে গেছে। এটি দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একজন কার্যকর রাজনৈতিক দল হিসেবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক এবং সমন্বয়মূলক হওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে দলটির ভিতরে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে।
আজকের সময়ে আওয়ামী লীগ কার্যত বিরোধী দলের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এর পেছনে রয়েছে দুটি মূল কারণ: প্রথমত, দলের আদর্শ ও নীতি থেকে সরে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, দলের শীর্ষ নেতাদের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমে যাওয়া। দেশের বাইরে থেকে প্রাপ্ত টকশোতে, যেখানে দলের একজন শীর্ষ নেতা আবদুর রহমান বলেন, "যে সাপে দংশন করেছে, সে সাপই বিষ নামাবে", সেটি দলটির অবস্থার এক ভীতিকর চিত্র তুলে ধরে। তার কথায় স্পষ্ট, দলটি নিজেদের ভবিষ্যত অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে। এই ধরনের অসহায় মন্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি দলের শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এছাড়া, সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো যখন এক হয়ে মাঠে নামছে, তখন আওয়ামী লীগের অবস্থান একেবারে বিপরীত। জনগণ, যারা এক সময় আওয়ামী লীগকে তাদের মুক্তির বাহক হিসেবে দেখত, আজ বিরোধী দলগুলোর সমর্থনে সরে গেছে। বিশেষ করে বিএনপি, নাগরিক পার্টি এবং বাম গণতান্ত্রিক জোটগুলো সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় এবং দৃঢ় অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগের সামনে এখন এক কঠিন বাস্তবতা, এবং সেই বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হলে দলকে একটি মৌলিক আত্মসমীক্ষা করতে হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি নিজেদের ভুল সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পুনর্গঠন না করে, তবে তারা জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না।
এর জন্য প্রথমেই দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রয়োজন। একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, শৃঙ্খলা বজায় রেখে দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা এবং দলের আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। যদি আওয়ামী লীগ তার পুরোনো শক্তি ফিরে পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে এবং নিজের নৈতিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।
অতীতের শক্তিশালী আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক মাঠে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু আজ, সেই দলের অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। আত্মসমীক্ষা ও দলীয় কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে দলের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। দলের নেতাদের যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের কাছে ফিরতে হয়, তবে তাদেরকে তাদের পুরনো আদর্শে ফিরে আসতে হবে এবং দলীয় কাঠামোতে রাজনৈতিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এমনভাবে দলকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে জনগণ আবারও তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারে এবং আওয়ামী লীগ তার ইতিহাস ও রাজনৈতিক শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে।