
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়কালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আক্রমণ এবং বাকস্বাধীনতার সংকট- এগুলো একে অপরকে পরিপূরক করে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য সম্ভাব্য সমাধানগুলো পর্যালোচনার প্রয়াস করবো।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একাধিক বার গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। "ক্রসফায়ার" নামে পরিচিত এনকাউন্টারের মাধ্যমে প্রায়ই সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯২টি "এনকাউন্টার" ঘটনার মধ্যে ৩৪ জন ছিল মাদক সন্দেহভাজন, বাকিরা রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ নাগরিক। এই ঘটনা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গুমের ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ছয় মাসে ২৭ জন নিখোঁজ হয়েছেন, যার মধ্যে ৮ জনের লাশ পরে উদ্ধার করা হয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে কবে থামবে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস? বিচারহীনতা এবং অপরাধের প্রতি সরকারের উদাসীনতা জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ৪২৩টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২৮টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল। এর মধ্যে ২৩টি গণধর্ষণের ঘটনা ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে কুষ্টিয়ায় ৮ বছর বয়সী একটি শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহীতে এক কলেজ ছাত্রীর গণধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
তবে কেন এই বর্বরতা থামছে না? নারী ও শিশুরা কেন নিরাপদ নয়? সরকার কি এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে?
এটি সমাজের এক গভীর সংকট, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে। ২০২৪ সালে ১৯টি মন্দির এবং মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৪৭টি। এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগণের ওপর অত্যাচার এবং উচ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে।
তাহলে এই বিপ্লবী সরকারের নীরবতা কেন? সংখ্যালঘুদের প্রতি এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ সমাজে অস্থিরতা ও বিভাজন তৈরি করছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ জন সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় ৭৩টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং ৫টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে সাংবাদিক শফিকুল ইসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আটক করা হয়েছে, এবং "নিজেদের খবর" পোর্টালটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে যে, গণতন্ত্রে মিডিয়ার স্বাধীনতা কি নিষিদ্ধ? একটি দেশ গণতান্ত্রিক থাকতে হলে মিডিয়ার স্বাধীনতা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে মব লিঞ্চিং-এর ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ছয় মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ৫৮ জন নিরপরাধ মানুষ মারা গেছে। মব লিঞ্চিং-এর এই ঘটনাগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অকার্যকরতার কারণে প্রভাবিত হয়েছে।
তাই আমাদের প্রশ্ন করতেই হয়, রাষ্ট্রের ভূমিকা কোথায়? জনতার আদালত কেন এইভাবে চলে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন সময়মতো ব্যবস্থা নেয় না?
২০২৪-২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি ও জামাতের কর্মী-সমর্থকদের ওপর এক ভয়াবহ দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। ২,৩০০+ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১৪ জন নিহত হয়েছেন। হরতাল চলাকালে ছয়টি ঘটনায় পুলিশ গুলি চালিয়েছে।
তবে কি দাড়ালো! গণতন্ত্র কি শুধু ক্ষমতাসীনদের জন্য? অথচ বিরোধী দলের অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,২০০+ ফেসবুক পোস্ট ডিলিট করা হয়েছে। ব্লগারদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে, ৯ জন ব্লগারকে আটক করা হয়েছে। এটি একটি বিপজ্জনক লক্ষণ, যা বাকস্বাধীনতার সংকটকে নির্দেশ করে।
এখন কণ্ঠরোধের রাজনীতি আর কতদিন চলবে? আমরা কি সত্যি বলতে পারবো?
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
নিরপেক্ষ তদন্ত: সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনার তদন্ত অবিলম্বে করতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল: নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন: সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করতে হবে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল: মিডিয়ার স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করতে হবে।
রাজনৈতিক সংলাপ: সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংলাপ শুরু করতে হবে।
একটি দেশ তখনই সভ্য হয়, যখন তার নাগরিকরা নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারে। রাষ্ট্র যদি নিজেই নাগরিকদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাংলাদেশ কি এই অন্ধকারে ডুবে থাকবে? নাকি আমরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এর সমাধান খুঁজে পাবো? সময়ই উত্তর দেবে।
শাহাদাত নোমান
সহ-সম্পাদক
shahadatnoman4@gmail.com
তথ্যসূত্র:
ASK
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
মায়ের দাবী
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়