ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা: পশ্চিমা বিশ্বকে আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান

ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা: পশ্চিমা বিশ্বকে আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান
প্রকাশিত

বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধের অন্যতম চিত্র হলো ফিলিস্তিনের অবস্থা, যেখানে প্রতিদিন মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে থাকে, এবং তাদের মানবিক মর্যাদা প্রায়শই অস্বীকার করা হয়। ২৩ মার্চ, ২০২৫ তারিখে ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজার রাফায় এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক হামলা চালায়, যা বিশ্ববাসীকে আবারও জোরালোভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈষম্য, তাদের জীবন ও মৃত্যুর প্রতি অবহেলা কতটা গভীর এবং নির্দয়। হামলার শিকার হয়েছিল ১৫ জন সাহায্যকর্মী, যারা শুধু মানুষের সেবায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, কিন্তু তাদের এই মানবিক প্রয়াসকে যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এই ঘটনার পর, ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছিল যে, তারা হামলার সময় ‘সশস্ত্র গোষ্ঠী’র উপস্থিতি সন্দেহে ওই অ্যাম্বুলেন্স বহরটি লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু পরে এই দাবিটি অস্বীকার হয়, যখন উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ফুটেজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ওই অ্যাম্বুলেন্সগুলো ছিল নিঃসন্দেহে চিকিৎসা কার্যক্রমের অংশ এবং সেখানে কোনো অস্ত্র ছিল না। এমনকি নিহত চিকিৎসক রিফাত রাদওয়ানের মোবাইলে উদ্ধার হওয়া ফুটেজে, অ্যাম্বুলেন্সটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং সেখানে গুলি বর্ষণও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তার মরদেহ এবং অন্যান্য নিহতদের শিরস্ত্রাণের অবস্থা প্রমাণ করে, তারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এটি শুধুমাত্র হত্যার ঘটনা ছিল না, বরং হত্যাকারীরা তাদের মানবিক মর্যাদাকেও মুছে ফেলতে চেয়েছিল।

দুঃখজনকভাবে, ঘটনাটি ঘটার পরও পশ্চিমা মিডিয়া প্রথমে ইসরায়েলি বাহিনীর বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তারা ‘ইসরায়েলি সূত্রমতে’ এবং ‘আইডিএফ-এর মতে’ এই হামলার ব্যাখ্যা দিয়েছিল। এটি একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা, যেখানে ফিলিস্তিনিরা তাদের জীবন ও মৃত্যুর জন্য প্রমাণ দিতে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনির মৃত্যুকে ‘শোক’ হিসেবে উপস্থাপন করার পরিবর্তে, তাদের প্রায়ই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একদিকে যেখানে ইসরায়েলি নাগরিক বা পশ্চিমা সাংবাদিকদের হত্যার ঘটনা ঘটলে তাদের সম্মান জানানো হয়, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা যখন মারা যান, তাদের মর্যাদা প্রমাণের জন্য তাদের পরিবারকে প্রথমে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অবিহিত হতে হয়, যা সরাসরি তাদের মানবিক মর্যাদাকে অস্বীকার করে।

ফিলিস্তিনিদের এই অবহেলা শুধুমাত্র ভাষাগত ভুল বা মিডিয়া বিভ্রান্তির ফল নয়, এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতির অংশ। পশ্চিমা মিডিয়া যখন ইসরায়েলি দৃষ্টিকোণকে অগ্রাধিকার দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অবিশ্বাস্য বা আবেগপ্রবণ হিসেবে উপস্থাপন করে, তখন সেই শোকের কোনো বাস্তবতা থাকে না, যা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অবিচার সৃষ্টি করে। ফিলিস্তিনিরা যেমন একটি বৈধ রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে, তেমনই তাদের মানবিক মর্যাদাকেও সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা উচিত।

এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শুধু রাজনৈতিক সংকটই নয়, ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকটও একটি বৃহত্তর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের জীবনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং বারবার প্রমাণ করতে হয় যে তারা সন্ত্রাসী নন। এটি কেবল তাদের জীবনের প্রতি অবিচারের প্রতিফলন নয়, বরং এটি তাদের পরিচয়কেও মুছে ফেলতে চাওয়ার একটি চক্রান্ত।

এখন সময় এসেছে, আমরা পুরোপুরি এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করি। ফিলিস্তিনিরা তাদের জীবন ও মর্যাদার জন্য কিছু প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তাদেরও অন্যান্য দেশের মানুষের মতো সমান মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলির উচিত ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন প্রদান করা। বিশ্বকে এই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে: কেন ফিলিস্তিনির জীবন ইসরায়েলি নাগরিকদের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়?

এখন, বিশ্বজুড়ে যখন এই প্রশ্ন উঠছে, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মৃত্যু এবং শোক কোনো জাতি, ধর্ম বা ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যারা মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করছেন, তাদের মৃত্যুতে আমরা সবাই সমানভাবে শোকাহত। এই চিকিৎসকরা, যারা রেড ক্রিসেন্ট বা জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে কাজ করছিলেন, তাদের জীবন কোন দেশের পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে মূল্যবান ছিল না। তাদের জীবন মূল্যবান ছিল মানবতার জন্য, এবং তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন—এটাই তাদের সাহস এবং মানবিকতার মূল চিত্র।

তাদের আত্মত্যাগ আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আমরা যদি এই বিশ্বে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা রাখি, তবে আমাদের সকল মানুষকে, তাদের জীবনকে এবং তাদের শোককে সমান মর্যাদা দিতে হবে।

আজ, ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। তারা যখন জীবিত ছিল, তাদের মর্যাদা খর্ব করা হয়েছিল; আজ, তাদের মৃত্যুর পরেও সেই মর্যাদাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা আমাদের কাজ। তবেই আমরা সত্যিকারভাবে মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের পক্ষ হতে পারব।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com