রোহিঙ্গারা ফিরবে কোন মিয়ানমারে?

রোহিঙ্গারা ফিরবে কোন মিয়ানমারে?
প্রকাশিত

একটি পুরনো সংকটের নতুন মুখোশ

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে আশ্রিত ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত এবং আরও ৭০ হাজার যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় আছে। কিন্তু এই ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাবাসন’ আদৌ কতটা বাস্তবসম্মত, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
২০১৭ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত প্রত্যাবাসন চুক্তির সাড়ে সাত বছর পর, এই হঠাৎ আগ্রহ কতটা আন্তরিক, আর কতটা কূটনৈতিক চাল—তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বারবার প্রতিশ্রুতি, বারবার ভঙ্গ

  • ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা ছিল।

  • বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত একজনকেও ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি।

  • এমনকি চুক্তির পরপরই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়া শুরু করে, চুক্তি লঙ্ঘন করে।

মিয়ানমারের পূর্ব প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় বর্তমান ঘোষণাটিকেও সন্দেহের চোখে দেখা স্বাভাবিক। মূল সমস্যা প্রতিশ্রুতি নয়, এর কার্যকারিতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।

দ্বিখণ্ডিত মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির উত্থান

আজকের মিয়ানমার আর ২০১৭ সালের মিয়ানমার নয়।

  • সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীগোষ্ঠীর মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে দেশটির ৭টি স্টেটের অধিকাংশ এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে, বিশেষ করে রাখাইন স্টেটের ৯০ শতাংশ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

  • রাখাইনে যেসব অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল, যেমন: মংডু, বুথিডং, রাথিডং, এসবই এখন আরাকান আর্মির হাতে।

  • মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিজেই এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত তাহলে তারা কিভাবে “ফেরত” নেবে?


  • এই বাস্তবতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা জান্তা সরকার যে ভূমিতে প্রবেশ করতে পারে না, সে ভূমিতে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন এবং রাজনৈতিক চাল বলেই প্রতিভাত হয়।

আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও বিমসটেক কূটনীতি

  • ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমার জান্তার অংশগ্রহণ নিয়েই জাতীয় ঐক্য সরকার (NUG) এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আপত্তি জানিয়েছে।

  • তারা বলেছে, জান্তা সরকার মিয়ানমারের জনগণের বৈধ প্রতিনিধি নয়, এবং বিমসটেকের নীতিমালাও তারা লঙ্ঘন করেছে।


মিয়ানমার জান্তা আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি একটি "Diplomatic Tokenism", যেখানে মুনাফা কূটনীতির, ক্ষতি বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান ও ভুল বাজি ধরার ঝুঁকি

বাংলাদেশ যদি জান্তার প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে চুপচাপ থাকে, তাহলে:

  • আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ কমে যাবে।

  • বাংলাদেশে অবস্থানরত ১৪ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থেই ‘স্থায়ী উদ্বাস্তু’ হয়ে যাবে।

  • রাজনৈতিকভাবে এটি হবে “মরা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরার” কৌশল, যা সময় ও কূটনৈতিক সুযোগ উভয়ই নষ্ট করবে।


বাংলাদেশের উচিত হবে মধ্যস্থতাকারী শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মিকে বিবেচনায় নেওয়া, কারণ বাস্তবিক ক্ষমতা এখন তাদের হাতে।

নিরাপদ অঞ্চল ও বাস্তবসম্মত কূটনীতি

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের প্রস্তাব অনুযায়ী “রাখাইন স্টেটে হিউম্যানিটারিয়ান করিডোর বা UN-supervised Safe Zone প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

এক্ষেত্রে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নয়, আরাকান আর্মির সাথে সমঝোতা, নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার একমাত্র বাস্তব পথ।

নীতিগত প্রস্তাবনা:

  • বাংলাদেশ জাতিসংঘ, ভারত, চীন, এবং ওআইসি-কে একত্র করে একটি আঞ্চলিক কনসোর্টিয়াম গঠন করতে পারে।

  • আরাকান আর্মির সাথে গোপন বা প্রকাশ্য Track II diplomacy শুরু করা যায়।

  • ভিন্ন কূটনৈতিক ‘কার্ড’ ব্যবহার করে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুনরায় আলোচনার নেতৃত্বে যেতে পারে।

বিভ্রম নয়, বাস্তবতার রাজনীতি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেবল মানবিক নয়, রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুও বটে। বাংলাদেশ যদি শুধুমাত্র জান্তার প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করে, তাহলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আজ সময় এসেছে বাস্তবতাকে মুখোমুখি করার—আর সেটি হলো, রাখাইনের বর্তমান কর্তৃত্ব আরাকান আর্মির হাতে এবং সমাধানও সেই পথেই নিহিত।


এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনীতি শুধু প্রতিক্রিয়াশীল হলে চলবে না, হতে হবে প্রো-অ্যাকটিভ, কৌশলী ও বহুমাত্রিক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুধু জান্তার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করা মানে ভবিষ্যতের সংকটকে নিজের ঘাড়ে আমন্ত্রণ জানানো।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com