
সংগৃহীত ছবি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার আকাশে অশ্রু ও রক্তের বন্যা বয়ে যায়, যখন ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ওপর নির্দয় হামলা শুরু করে। এর পরিণামে ৫০,৬৯৫ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয় এবং ১,১৫,৩৩৮ জন আহত হয়, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এই মানবিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবী, বাংলাদেশসহ, গাজার প্রতি এক গভীর মানবিক সংহতি প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায়, শিক্ষার্থীরা একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে, যা একসময় আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে। আজ, “The World Stops for Gaza” একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে অন্তত ২০টি দেশ একযোগে প্রতিবাদ জানিয়ে গাজার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে।
ঢাকায় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ:
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, যেখানে শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবস্থিত, সেখানে শিক্ষার্থীরা গাজার মানুষের প্রতি তাদের সমর্থন জানাতে ৭ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদে অংশ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের অন্যান্য প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলন ছিল এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করে গাজার জনগণের প্রতি তাদের সংহতি জানিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, বুয়েটের প্রশাসনিক ভবন এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড্ডা লিংক রোডে মানববন্ধন এবং বিক্ষোভের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ। আন্দোলনকারীরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, “গাজার হত্যাযজ্ঞ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
এই আন্দোলনটি রাজনৈতিক প্রতিরোধের চেয়ে বেশি কিছু। এটি মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং সমষ্টিগত মানবিক দায়বদ্ধতার প্রতীক। এমনকি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কালো ব্যাজ ধারণ করে এবং ক্লাস স্থগিত করে প্রতিবাদ সভা আয়োজন করেছেন, যা একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল। এটি প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সংগৃহীত ছবি
বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ:
বাংলাদেশের আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, তুরস্ক, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে এবং অন্যান্য দেশগুলোতে লাখো মানুষ গাজার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। এই প্রতিবাদগুলো শুধু একক দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি এক বৈশ্বিক প্রতিবাদে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে তিন লাখেরও বেশি মানুষ লন্ডনের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। তুরস্কের ইস্তানবুল এবং ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়ও বিশাল বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমেরিকার নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে গাজার পক্ষ নিয়েছে। একইভাবে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, ফ্রান্সের প্যারিস, এবং ব্রাজিলের সাও পাউলোতেও প্রতিবাদী মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনেও হাজারো মানুষ গাজার জন্য তাদের সমর্থন জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই প্রতিবাদগুলো একযোগে গাজার জনগণের প্রতি সমর্থন এবং মানবাধিকারের প্রতি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে, আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া আজ প্রতিবাদের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। '#StopGenocideInGaza', '#BoycottIsrael', '#FreePalestine'—এই হ্যাশট্যাগগুলো বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং। শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ জনগণ সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিচ্ছে, ভিডিও, রিলস, পোস্টের মাধ্যমে তাদের বার্তা পৃথিবীজুড়ে পৌঁছে দিচ্ছে।
সংগৃহীত ছবি
বাংলাদেশে বয়কট আন্দোলন:
ঢাকার প্রতিবাদ শুধু রাস্তায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি একটি অর্থনৈতিক প্রতিবাদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা ইসরায়েলি পণ্য বর্জন এবং তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার জন্য সচেতনতা তৈরি করছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পণ্য বর্জনের তালিকা বিলি করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ মানুষ নিজেদের খরচের মাধ্যমে গাজার মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে।
এই বর্জন আন্দোলন এক ধরনের বৈশ্বিক আন্দোলন তৈরি করেছে, যেখানে শুধু সরকার বা জাতির নয়, সাধারণ জনগণও তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করছে। গাজার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ শুধু একটি রাজনৈতিক বিরোধ নয়; এটি একটি গভীর মানবিক সংকল্পের প্রকাশ, যেখানে সবাই একত্রিত হয়ে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
সংগৃহীত ছবি
বিশ্ব নেতাদের দায়িত্ব:
গাজার মানবিক বিপর্যয় আজ শুধু ফিলিস্তিন বা মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব নেতাদের উচিত, তারা যেন এই সংকটের অবসান ঘটাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ জরুরি, যেন ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হয় এবং গাজার মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পায়।
বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং অন্যান্য, তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতির প্রতি অবিচল থাকলেও, তাদের উচিত গাজার জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা এবং সমর্থন প্রকাশ করা। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর মতো, বাংলাদেশও তাদের প্রতিবাদ ও সংহতি জানিয়ে এই সংকটে মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।
সংগৃহীত ছবি
আজকের প্রতিবাদ কেবলমাত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থানকে প্রতিফলিত করছে না, বরং এটি পৃথিবীজুড়ে মানবতার পক্ষে একটি শক্তিশালী বার্তা। ঢাকার রাজপথে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ থেকে উঠে আসা এই প্রতিবাদ, যা সরাসরি রাজনীতি নয়, বরং মানবতার পক্ষে, তা আমাদের প্রত্যেককে ভাবাতে বাধ্য করে।
আজ, পৃথিবী একজোট হয়ে গাজার জন্য প্রতিবাদ করেছে। বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে মানবতার পক্ষে এই বার্তা উঠে এসেছে, "আমরা গাজার জন্য প্রতিবাদ করবো, আমাদের সংগ্রাম থামবে না।" আজকের আন্দোলন এবং এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে একটি পরিষ্কার বার্তা পাঠানো হয়েছে যে, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কখনো থামবে না।