
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সবচেয়ে প্রাণবন্ত, ঐক্যবদ্ধ ও শিকড়সন্ধানী উৎসবগুলোর একটি। বৈশাখের প্রথম দিনটিকে ঘিরে যে আবেগ, যে প্রাণচাঞ্চল্য তা বছরের অন্য কোনো দিনে দেখা যায় না। অথচ এই উৎসবটিকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে যে বিভ্রান্তি, ভুল ব্যাখ্যা ও বিতর্কের জন্ম হচ্ছে, তা কেবল দুঃখজনকই নয়-এটি আমাদের জাতিসত্তার ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটি কৌশলী প্রচেষ্টা।
বাংলা সনের সূচনা ঘটে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬–১৬০৫)। হিজরি চান্দ্রপঞ্জি কৃষিকাজের সঙ্গে মিলছিল না, ফলে চাষিদের ওপর আরোপিত খাজনা আদায় ছিল সমস্যাসঙ্কুল। এই সমস্যা সমাধানে আকবর "ফসলি সন" নামক এক সৌরপঞ্জির প্রচলন করেন, যা থেকেই আমাদের বাংলা সনের সূচনা। এটি ছিল একটি প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ ধর্মীয় নয়।
বাংলা নববর্ষ তাই জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ, কৃষিনির্ভর এবং প্রশাসনিক বাস্তবতা থেকে উৎসারিত। পরবর্তীতে, এই দিনটিকে ঘিরে গড়ে ওঠে বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক রীতি যেমন হালখাতা, বৈশাখী মেলা, গ্রামীণ গান, লোকজ শিল্প ইত্যাদি।
বর্তমানে একটি বিশেষ শ্রেণি, বিশেষ করে ধর্মীয় গোঁড়ামি বা মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুপ্রাণিত কিছু গোষ্ঠী বাংলা নববর্ষকে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করতে চাইছে।
তাদের মূল অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের “রথযাত্রা”র অনুকরণ, মুখোশ ব্যবহার ও প্রতিকৃতি আঁকা “মূর্তিপূজার” উপসর্গ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ও ঢাক-ঢোল “ইসলাম বিরোধী”
তবে সমাজ বিশ্লেষকদের মতে এই ব্যাখ্যা শুধু ভ্রান্ত নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ- নববর্ষ উৎসবের কোনো ধর্মীয় আচার নেই; এটি সম্পূর্ণভাবে ‘সামাজিক ও সাংস্কৃতিক’। মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ‘১৯৮৯ সালে চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা’, যারা রাজনৈতিক দুঃসময়ে ফ্যাসিবাদ ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ চেয়েছিলেন। এটি কখনোই হিন্দু ধর্মীয় রীতির অনুসরণ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ”গান যেমন সকল বাঙালির প্রাণের গান, তেমনি নববর্ষও ‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকলের’ যার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবেও পাওয়া গেছে।
এখানেই আসে আরেকটি বিতর্ক- নববর্ষ কি শুধুই “আনন্দের”উৎসব, না কি “মঙ্গল” চেতনার বহিঃপ্রকাশ? একটি সময় ছিল যখন পহেলা বৈশাখ মানে ছিল মিষ্টি খাওয়া, পান্তা-ইলিশ, হালখাতা আর গান-বাজনা। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এটি হয়ে উঠেছে ‘প্রতিবাদের ভাষা’, ‘বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষার এক জাগরণদিবস’।
“মঙ্গল শোভাযাত্রা”র নামটি অনেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তারা বলেন, ‘মঙ্গল’ শব্দটি হিন্দু ধর্মীয়। অথচ এই শব্দটি বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত এবং ধর্মনিরপেক্ষ:
“মঙ্গল কামনা’,“মঙ্গলপ্রদ ভবিষ্যৎ’’ “মঙ্গলজনক সিদ্ধান্ত”
এসব শব্দ তো আমরা মুসলিম হয়েও উচ্চারণ করি!
তবে, এই বিতর্ক আসলেই কি শব্দ বা রীতি নিয়ে? না কি এটি ‘সংস্কৃতি দখলের রাজনীতি’?
বাংলাদেশ একটি জাতিগতভাবে মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ হলেও ‘বাঙালি জাতিসত্তা সবসময়ই ধর্মের ঊর্ধ্বে’। মৌলবাদী রাজনীতির জন্য এটা একধরনের হুমকি কারণ ‘একটি ধর্মনিরপেক্ষ, শক্তিশালী সংস্কৃতি মানেই চিন্তার স্বাধীনতা, প্রতিবাদের ভাষা এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র’।
তাই তারা নববর্ষকে টার্গেট করে। কখনো “হারাম” বলে ফতোয়া দেয়, কখনো “মূর্তিপূজা” বলে গুজব ছড়ায়।
বাংলা নববর্ষ কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়। এটি বাঙালির চেতনার উৎসব। এটি এমন একটি দিন যেখানে ‘ধর্ম, দল, পেশা, শ্রেণি সব পেরিয়ে আমরা একত্র হই একটি পরিচয়ে: আমরা বাঙালি।‘
যারা নববর্ষকে “অ-ইসলামিক” আখ্যা দিয়ে বন্ধ করতে চায়, তারা শুধু একটি উৎসব নয় 'তারা বাঙালিত্বকেই অস্বীকার করছে’।
তাদের প্রতিহত করতে হবে যুক্তি দিয়ে, ঐতিহাসিক সত্য দিয়ে, এবং সংস্কৃতি চর্চা দিয়ে।
“বাংলা নববর্ষকে যদি রক্ষা করতে হয়, তবে কেবল উৎসবে অংশ নিয়ে নয়, 'ভ্রান্ত প্রচার ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েই তা সম্ভব।”