
বহু বছর ধরে “বেল বন্ড” ছিল আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্ত সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে ভোগান্তিপূর্ণ ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। আদালত জামিন মঞ্জুর করলেও মুক্তি পেতে বন্দিদের অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘসময়। কারণ আদালতের জামিন আদেশ—যা বেল বন্ড নামে পরিচিত—কারাগারে পৌঁছাতে হতো ১২টিরও বেশি জটিল ধাপ অতিক্রম করে।
আইনজীবীর টেবিল, কোর্ট ইন্সপেক্টর, কোর্ট ক্লার্ক, ম্যাজিস্ট্রেট স্বাক্ষর, ডাক বিভাগে প্রেরণ (যদি ভিন্ন জেলা হয়), জেলখানার নথিপত্র যাচাই, সিপাহীর মাধ্যমে ফাইল প্রক্রিয়া, জেল সুপারের অনুমোদন—এই অসংখ্য ধাপ পেরিয়ে অবশেষে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেতেন। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় নানান হয়রানি, দালালি সিন্ডিকেট, সময়ক্ষেপণ ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।
এতো জটিলতা ও দেরির কারণেই একজন মানুষ আদালত থেকে জামিন পেলেও অনেক সময় ৩ দিন, ৭ দিন এমনকি ১৪ দিন অতিরিক্ত কারাভোগ করতেন—শুধুমাত্র একটি কাগজের বিলম্বের কারণে।
সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী একবার বলেছিলেন—তার এক মক্কেল জামিন পাওয়ার পরও আরও ১৪ দিন অতিরিক্ত জেল খেটেছেন, শুধুমাত্র বেল বন্ড কারাগারে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণে।
ঢাকার একটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে আমি নিজে কথা বলেছিলাম এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে—তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, “স্যার, আমার স্বামী জামিন পেয়েছিল তিনদিন আগে, কিন্তু বেলবন্ড না আসায় আমরা প্রতিদিন এই গেটেই অপেক্ষা করেছি…”
এই বাস্তবতা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয় একজন গণমাধ্যম কর্মী ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা হিসেবে।
৫ আগস্ট ২০২৫—একটি সাধারণ ফোন কল আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি নির্মাণের সূচনা করে। একজন ঘনিষ্ঠ মানুষ আমাকে বললেন: “তুফান ভাই, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ আছে—বেল বন্ড নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানাতে হবে।”
শুরুতে বিষয়টি আমার কাছে খুব সাধারণ মনে হয়েছিল। কিন্তু শুটিং করতে গিয়ে যখন ভুক্তভোগী মানুষদের সঙ্গে কথা বললাম, তখন বুঝলাম—এটি শুধু একটি আইনগত ধাপ নয়, এটি মানুষের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সাথে জড়িত একটি মানবিক বাস্তবতা।
শেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম মাননীয় আইন উপদেষ্টা স্যারের সাথে। তিনি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেন—বেল বন্ড আসলে কী, এবং কেন এটি ডিজিটাল হওয়া সময়ের দাবি ছিল।
এই দীর্ঘ ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে ডিজিটাল বেল বন্ড সিস্টেম চালু হয়। নতুন ব্যবস্থায় আদালতের জামিন আদেশ কারাগারে পাঠানো হয় অনলাইনে এক ক্লিকেই—আইনজীবী → ম্যাজিস্ট্রেট → জেল সুপার—সবই এখন ই-সিস্টেমে।
এর ফলে:
সময় বাঁচছে
হয়রানিমক্ সেবা নিশ্চিত হচ্ছে
দুর্নীতি কমছে
দ্রুত মুক্তি পাচ্ছেন জামিনপ্রাপ্ত মানুষ
১৫ অক্টোবর ২০২৫, নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউজে যুগান্তকারী ই-বেলবন্ড কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিচারব্যবস্থা ও আইন বিভাগের সর্বোচ্চ পদস্থ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
· ড. আসিফ নজরুল – উপদেষ্টা, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
· ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব – প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী
· মোঃ আসাদুজ্জামান – অ্যাটর্নি জেনারেল
· লিয়াকত আলী মোল্লা – সচিব, আইন ও বিচার বিভাগ
· ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী – সচিব, লেজিসলেটিভ বিভাগ
· মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী – রেজিস্ট্রার জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট
· ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোঃ মোতাহের হোসেন – কারা মহাপরিদর্শক
· মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা – জেলা প্রশাসক, নারায়ণগঞ্জ
· মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন – পুলিশ সুপার, নারায়ণগঞ্জ
· এবং আরও অনেকে
এই অনুষ্ঠানে “বেল বন্ড: এখন সহজ, এখন ডিজিটাল”—শিরোনামে পজিটিভ থিংক নির্মিত আমাদের ডকুমেন্টারিটি প্রদর্শিত হয়, যা উপস্থিত সবাই প্রশংসার সাথে গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়—এটি শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরং মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও সাধারণ মানুষের মুক্তি নিশ্চিতের একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ।
ই-বেলবন্ড শুধু একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়—এটি মানবাধিকারের সুরক্ষা, ন্যায়ের দ্রুত প্রয়োগ এবং সাধারণ মানুষের মুক্তি অর্জনের পথকে সহজ করেছে।
লেখক -খাইরুল ইসলাম তুফান
ডকুমেন্টারি নির্মাতা