সমরে-শান্তিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
দেশের রাজপথ, গ্রাম, মফস্বল কিংবা দূর পাহাড়- যেখানেই মানুষের ভয় একটু বেশি, সেখানেই নিরাপত্তার দৃশ্যপটটাকে শক্ত করে দাঁড় করানোর দায়িত্ব এখন যৌথ বাহিনীর কাঁধে। ৫ আগস্ট ২০২৪, এর পর থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনীয়তার জায়গা থেকেই পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।
শুধু অভিযান নয়; এটা মানুষের স্বস্তির দিকে ফিরে যাওয়ার একটা লম্বা পথচলা-
১. অভিযানের ভেতরের মানবিকতা
নৈরাজ্য সীমাবদ্ধ করতে, নিরস্ত্র মানুষকে নিরাপদ রাখতে—বাহিনীর সদস্যদের এই কয়েক মাস যেন দিন-রাতের একটা অবিরাম কাজ।
অনেকেই রাতভর টহলে থাকেন, নিঃশব্দ শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে জনবহুল বাজার—সবকিছুর ভেতর দিয়ে ঠিক করে রাখেন “মানুষ যেন নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে।”
গ্রেফতার বা উদ্ধার অভিযানের পেছনে মূল উদ্দেশ্য অপরাধ কমানো হলেও, বাস্তবে এর ভেতর আছে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক কমানোর এক বিশাল দায়িত্ব।
মাদক, অস্ত্র, কিশোর গ্যাং বা সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে যে অভিযানগুলো চলছে, সেগুলো শুধু অপরাধী ধরতে নয়—বরং প্রতিটি এলাকায় স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসার চেষ্টা।
২. মাঠপর্যায়ের কাজ: শহর–মফস্বল–গ্রাম
টহল ও নজরদারি-
মাঠপর্যায়ে যৌথ বাহিনীর টহল এখন নিয়মিত দৃশ্য।
শহরে রাতের বেলায় চেকপোস্ট, কৌশলগত স্থানে নজরদারি, সন্দেহজনক চলাচলে জিজ্ঞাসাবাদ—এসব তৎপরতা মানুষের মনে আস্থা বাড়াতে সাহায্য করছে।
অভিযান ও গ্রেফতার-
বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে চক্রভিত্তিক অপরাধী, সন্ত্রাস-সন্দেহভাজন, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী—বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের ধরা হচ্ছে।
অবৈধ অস্ত্র, কার্তুজ, ককটেল, চোরাই মোটরসাইকেল, মোবাইল, নগদ অর্থ—অনেক কিছুরই উদ্ধার দেখা যাচ্ছে।
অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য খুব সহজ—“অপরাধমূলক নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া।”
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি-
অনেক এলাকাতেই মানুষ বলে,
“রাতে বের হলেই ভয় থাকত। এখন অন্তত রাস্তা শান্ত।”
এই শান্তিটাই অর্জন করতে যৌথ বাহিনীর রাত-জাগা টহল, দিনের বেলায় ঝুঁকি নিয়ে অভিযান, আর অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ, সবই নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে।
করোনা যুদ্ধে সম্মুখে
৩. পাহাড়ি অঞ্চলে তৎপরতা: জটিলতার ভেতর শান্তির প্রচেষ্টা
দেশের পার্বত্য অঞ্চল—রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি—এখানকার চিত্র অন্যরকম।
পাহাড় মানে জটিল ভূপ্রকৃতি, বিচ্ছিন্ন গ্রাম, সীমান্তবর্তী পথ, আর বহু সময় অজানা ঝুঁকি।
এই জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা একেবারে আলাদা ধাঁচের।
সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা মোকাবিলা-
পাহাড়ের বহু এলাকায় ছোট-বড় সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি—চাঁদাবাজি, অপহরণ, অবৈধ অস্ত্র পরিবহন, আঞ্চলিক উত্তেজনা—এসবই প্রতিনিয়ত পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে।
এখানে সেনাবাহিনী শুধু অভিযানই চালায় না—স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ থেকে শুরু করে দূরবর্তী গ্রামে শান্তি বজায় রাখা—সবই তাদের দায়িত্বের অংশ।
গ্রামভিত্তিক নিরাপত্তা ও মানবিক উপস্থিতি
পাহাড়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধু নিরাপত্তা নয়-
অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া,
দুর্গম স্কুলে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো,
বন্যা/ভূমিধসে উদ্ধার অভিযান,
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা
এসব মানবিক কাজও প্রতিদিনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে।
চ্যালেঞ্জ-
অভিযান পরিচালনার সময় পাহাড়ের অজানা ভূপ্রকৃতি, রাতের অন্ধকার, বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পথ—সবই ঝুঁকি বাড়ায়। তবুও আইনশৃঙ্খলা দৃঢ় রাখতে সেখানে শক্ত অবস্থানে আছে যৌথ বাহিনী।
৪. রাষ্ট্র–সমাজ–মানুষ: নিরাপত্তার বৃহত্তর চিত্র
এই কয়েক মাসের কাজ দেখে যে বিষয়টি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়—দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখতে যৌথ বাহিনীর তৎপরতা একধরনের মানবিক দায়িত্ববোধ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
এটা শুধু অপরাধ দমন নয়—
এটা মানুষের স্বাভাবিক জীবন ফেরত দেওয়ার প্রচেষ্টা।
রাস্তা নিরাপদ হওয়া, দোকান সময়মতো খুলে থাকা, শিশুরা খেলতে পারা, পাহাড়ের মানুষদের শান্তিতে ঘুমানো—এসবই আসলে দেশের স্থিতিশীলতার মৌলিক ছবি।
নিরাপত্তা রক্ষায় যৌথ বাহিনী
৫. উপসংহার
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের কাছে নিরাপত্তা শুধু একটি শব্দ নয়; এটা তাদের প্রতিদিনের জীবনের মানসিক শান্তি।
যৌথ বাহিনীর মাঠপর্যায়ের এই দীর্ঘ তৎপরতা—হোক সেটা শহরের অন্ধকার গলি, সীমান্তবর্তী গ্রাম বা পাহাড়ের কঠিন পথ—একই লক্ষ্যকে সামনে রাখে:
দেশের মানুষ যেন নির্ভয়ে, নিরাপদে, নিজস্ব জীবনে ফিরতে পারে।
এই মানবিক লক্ষ্যই পুরো অভিযানের মূল শক্তি।