দুর্বল প্রতিষ্ঠানেই গণতন্ত্র-মানবাধিকার এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি

মুখ পাল্টেছে : পাল্টায়নি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো
দুর্বল প্রতিষ্ঠানেই গণতন্ত্র-মানবাধিকার এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি
প্রকাশিত

দেশে আজ যে রাজনৈতিক তাপমাত্রা, তার উৎপত্তি কোনো একক ঘটনা বা ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নয়- এর গভীরে রয়েছে বহু বছরের জমে ওঠা প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা।

রাজনীতি পাল্টেছে বারবার, সরকার পাল্টেছে, তবে গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার- এই তিনটি স্তম্ভই টিকে আছে এক ধরনের সংকট-নির্ভর ভারসাম্যে, যাকে কেউই স্থায়ী ভিত্তি বলে মানতে পারছে না।

এই দেশের বড় রাজনৈতিক সত্যটি হলো- 

এখানে সমস্যা সরকারবদল নয়, সমস্যা ইনস্টিটিউশন-দুর্বলতা।

এবং সেই দুর্বলতার সুবিধা নেয় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী; ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনগণ।

গণতন্ত্র: যে কাঠামো এখন ‘ফাংশনাল’ কিন্তু ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নয়,

বহু দেশে গণতন্ত্রের মান নির্ধারণ হয় ভোটের অংশগ্রহণ, প্রতিযোগিতা ও সমান সুযোগ দিয়ে।

কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র এক অদ্ভুত বাস্তবতা—

প্রক্রিয়া আছে, কাঠামো আছে, অথচ আস্থা নেই।

  • নির্বাচনের বড় প্রশ্ন-  ‘ফলাফল প্রশ্ন নয়, প্রক্রিয়া কি বিশ্বাসযোগ্য?’

এ দেশের ভোট নিয়ে সমস্যাটা ফলাফলে নয়—সমস্যা ‘বিশ্বাসে’।

যখন বড় অংশের জনগণ মনে করে ফল পূর্বনির্ধারিত, তখন নির্বাচন গণতন্ত্র হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংকোচন-

যে গণতন্ত্রে বিরোধী মত শক্ত অবস্থান নিতে পারে না, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দমে যায়, সেখানে ক্ষমতার বৈধতা দুর্বল হয়ে পড়ে।

রাজনীতি তখন হয়ে যায় একদলীয় সুবিধার ওপর দাঁড়ানো একটা “সিস্টেম”—যা টিকে থাকে কিন্তু জনগণের আস্থায় ভরসা পায় না।

বিচারব্যবস্থা: স্বাধীনতার বদলে নির্ভরতার ছায়া

  • বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে দুটি চাপে থাকে-

১) রাজনৈতিক চাপ

২) প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ

দুই ক্ষেত্রেই একটি দীর্ঘস্থায়ী ধারণা তৈরি হয়েছে-

“বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয়, বরং অবস্থাভেদে নির্ভরশীল।”

  • সংবেদনশীল মামলায় রাজনৈতিক ‘টোন’ স্পষ্ট-

এই দেশে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর রায় প্রায়ই ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি রাখে।

এটি বিচারব্যবস্থার ওপর জনআস্থার বড় ক্ষতি করে।

  • তদন্ত সংস্থার ‘চয়েসড অ্যাকশন’

কোন মামলা তাড়াতাড়ি হবে, কোনটা হিমঘরে যাবে—এই সিদ্ধান্ত অনেক সময় তদন্তের মান বা গুরুত্বের ওপর নয়, বরং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে বলে জনমনে বিশ্বাস রয়েছে।

মানবাধিকার: রাষ্ট্রীয় শক্তির সামনে ব্যক্তি অধিকার ক্ষীণ

মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের বাস্তবতা আরও তীব্র।

মতপ্রকাশ, রাজনৈতিক সমাবেশ, আইনি সহায়তা, সংবাদমাধ্যম—সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের চাপ কাজ করে।

  • মতপ্রকাশের ক্ষেত্র সংকুচিত-

অনলাইন পোস্ট, ব্যঙ্গচিত্র, রাজনৈতিক মন্তব্য—সবকিছুই আইনের এক ঝুঁকিপূর্ণ গোলকধাঁধায়।

ফলে জনগণ নিজেই নিজেকে সেন্সর করছে।

  • নিখোঁজ, গ্রেফতার ও গুম- আস্থাহীনতার গভীরতম দাগ-

বছরের পর বছর ধরে নিখোঁজ ও গুম নিয়ে যে ভয় তৈরি হয়েছে, তা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

নাগরিক স্বাধীনতার এই সংকোচন রাজনৈতিক স্থিতিকে দুর্বল করে, সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলে।

  • মূল যে সমস্যাটি : ইনস্টিটিউশনগুলো শক্ত নয়, বরং ‘প্রভাব নির্ভর’

রাষ্ট্র চালাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্তম্ভ-

  1. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন

  2. স্বাধীন বিচারব্যবস্থা

  3. স্বাধীন মিডিয়া

কিন্তু বাংলাদেশে এই তিনটি স্তম্ভই রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।

এটাই পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সবচেয়ে গভীর ক্ষতঃ

  • নির্ভরতার এই কাঠামো দুই পক্ষকেই দুর্বল করে

  • ক্ষমতাসীন পক্ষ মনে করে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ছাড়া তার নিরাপত্তা নেই

  • বিরোধী পক্ষ মনে করে চ্যালেঞ্জ জানানোর কোনো সুযোগ নেই

  • জনগণ মনে করে তার ভোট বা মতামতের কোনো মূল্য নেই

  • ফলে তিন পক্ষই কমবেশি অনাস্থা-নির্ভর অবস্থায় থাকে।

  • কিভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হলো?

এ প্রশ্নের উত্তর এক লাইনে নয়- বরং বহু বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে লুকানোঃ

১. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ-

রাষ্ট্রের প্রায় সব নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে এক কেন্দ্রের দিকে সরতে থাকে।

যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, সেখানে প্রতিষ্ঠান দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক।

২. পদমর্যাদার চেয়ে ‘পদ-নির্ভর আনুগত্য’-

বহু প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব এখন মেধা নয়, বরং আনুগত্য দিয়ে নির্ধারিত হয়।

ফলে স্বাধীনতা নয়, নির্দেশ মানাই হয়ে ওঠে প্রধান কাজ।

৩. জবাবদিহির অভাব

যে দেশে জবাবদিহি নেই, সেখানে ভুল করার সুযোগ বাড়ে, কিন্তু তার সাজা নেই।

ফলে প্রতিষ্ঠান চলে, কিন্তু শক্তি হারায়।

তাহলে সমাধান কোথায়?

গণতন্ত্র কাগজে লেখা, মানবাধিকার স্লোগান, বিচারব্যবস্থা কাঠামো—এসব দিয়ে দেশ চলে না।

দেশ চলে কার্যকর প্রতিষ্ঠান দিয়ে।

  • যে পাঁচটি সংস্কার আজ জরুরি

১) নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে সাংবিধানিক শক্তিশালীকরণ

২) বিচারকদের নিয়োগ ও বদলিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত ব্যবস্থা

৩) নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহি বাড়ানো

৪) মতপ্রকাশে আইন শিথিল করা

৫) সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কার্যপরিধি প্রতিষ্ঠা করা

এই সংস্কারগুলো ছাড়া কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনই স্থায়ী হবে না।

শেষ কথা- রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে প্রথমে ইনস্টিটিউশনকে বাঁচাতে হবেঃ

রাজনীতির সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো :

ক্ষমতাবদল রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে না- শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রকে রক্ষা করে।

গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার ; এই তিন স্তম্ভের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে

রাষ্ট্র কত দ্রুত ও কত সাহস নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক করতে পারে তার ওপর।

যতক্ষণ পর্যন্ত এই কাজটি না হবে,

ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক উত্তাপ কমবে না, আর জনগণের আস্থাও ফিরবে না।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com