খালেদা জিয়া : তাঁর তুলনা তিনি নিজেই

খালেদা জিয়া : তাঁর তুলনা তিনি নিজেই
প্রকাশিত

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিত্ব অনন্য, তাঁকে বিভিন্ন সময় যারা কাছ থেকে দেখেছেন তারা এ কথা সহজেই স্বীকার করে থাকেন। এছাড়া দূর থেকেও যারা তাঁকে দেখেছেন, তারাও বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি অনন্য চরিত্রের অধিকারী। 

শুধু আপসহীনতার জন্য নয়, ত্যাগ স্বীকার ও কষ্ট সহ্য করার অপরিসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। এ ধরনের চরিত্র খালেদা জিয়া পেয়েছিলেন তাঁর মা-বাবা এবং স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে।

তাঁর সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া জনপ্রিয়তার বলে বলীয়ান ছিলেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র। সেই রক্ষণশীল রাষ্ট্রে তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। নারীদের ঘিরে যেসব প্রথা প্রচলিত ছিল, তিনি সেগুলো ভেঙে দিয়েছেন। বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রায় ওনার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমার সবসময় মনে হয়।’

বেগম খালেদা জিয়ার জীবনীকার ও প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া বিধবা হওয়ার পর তাঁর পুরো জীবন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাতিঘর হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন। বেগম জিয়া হচ্ছেন বাংলাদেশের রাজনীতির একজন বংশীবাদক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার সিনোনিম হচ্ছেন খালেদা জিয়া।’

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।’

পারিবারিক আবহ থেকে খালেদা জিয়ার সৎ, আদর্শবাদী, উদার, আধুনিক অথচ দৃঢ়চেতা মন তৈরি হয়েছিল। পরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সান্নিধ্যে থেকে তা আরো বিকশিত ও বলিষ্ঠ হয়।

বেগম খালেদা জিয়ার বাবার আদি নিবাস ফেনীতে। তাঁর বাবা ইসকান্দার মজুমদারের জন্ম ফেনীর পরশুরামে। পড়ালেখার প্রয়োজনে ইসকান্দার মজুমদার তার বোনের বাড়ি ভারতের জলপাইগুড়ি যান। সেখানে তিনি মাধ্যমিকের শিক্ষাজীবন শেষ করেন। 

জলপাউগুড়িতেই চা বাগানে কাজ নেন ইসকান্দার মজুমদার। তবে কিছুদিন পর তিনি যুক্ত হন চায়ের ব্যবসায়। সেখানে টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় বেগম তৈয়বা মজুমদারের সঙ্গে। তার বাড়ি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে। ১৯৩৭ সালের ১৯ মার্চ ইসকান্দার ও তৈয়বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় তিন কন্যা ও দুই ছেলে। যাদের একজন বেগম খালেদা জিয়া। তাদের মধ্যে খালেদা জিয়া ছিলেন তৃতীয়। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট।

পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার বাবা-মা দিনাজপুরে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই ব্যবসা শুরু করেন ইসকান্দার মজুমদার। বেগম খালেদা জিয়া দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। খালেদা জিয়া তাঁর স্কুলের শিক্ষকদের সবসময় মনে রাখতেন। দিনাজপুর গেলে তিনি তাদের খোঁজখবর নিতেন। স্কুলজীবনে তিনি বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতেন। সেগুলোতে তিনি ভালোও করতেন। 

খালেদা জিয়ার মা ছিলেন একজন সমাজসেবক, উদার ও আধুনিকমনস্ক। বাবাকে লুকিয়ে খালেদা জিয়া তাঁর বোনসহ সিনেমা দেখতে যেতেন। তাঁর ছিল দীঘল চুল। ছোটবেলা থেকে খালেদা জিয়া ছিলেন পরিচ্ছন্নতা সচেতন। ছোটবেলা আত্মীয় নার্গিসের সঙ্গে নাচ শিখতেন তিনি। এতে তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। মা তৈয়বা তাঁকে এসব কাজে উৎসাহ দিতেন। বড় বোন বিউটির সঙ্গে খালেদা জিয়ার অনেক সখ্যতা ছিল। তাঁরা অনেক দুষ্টুমি করতেন। 

খালেদা জিয়া ফুল ভালোবাসতেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যস্ত সময়েও তাঁর রুচির পরিচয় পাওয়া গেছে । মায়ের কাছ থেকে তিনি আরেকটি যে জিনিস শিখেছিলেন, তা হলো হিসাব করে চলা। খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদার স্বামীর কাছ থেকে হাতখরচের জন্য যে অর্থ পেতেন, তা থেকে সঞ্চয় করে রাখতেন। অযথা বাজে খরচ করতেন না। এ স্বভাব ছিল খালেদা জিয়ারও। নিজের দুই ছেলে তারেক রহমান ও  প্রয়াত আরাফাত রহমানের পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবন-যাপনেও এর ছাপ ছিল। দামি পোশাক, বাহারি খাবারের প্রতি সন্তানদের আগ্রহকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। অল্প কয়েকটি পোশাক দীর্ঘদিন পরার অভ্যাস ছিল তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর।

রাষ্ট্র পরিচালনায়ও খালেদা জিয়ার এই হিসাব করে চলার অভ্যাস চোখে পড়ে। অযথা বড় বড় প্রকল্পগ্রহণ, সরকারি কোনো অর্জনকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের নজির নেই। জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধানে তিনি সাধাসিধে জীবন-যাপনকে সবসময় গুরুত্ব দিতেন। মায়ের কাছ শেখা এই চর্চায় তিনি জিয়াউর রহমানের কাছ থেকেও  অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।  

উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর বিয়ের কারণে খালেদা জিয়ার শিক্ষাজীবন আর দীর্ঘায়িত হয়নি । ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জিয়াউর রহমান তখন দিনাজপুরে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। তিনি অনেক আগে থেকেই খালেদা জিয়াকে পছন্দ করতেন। জিয়াউর রহমানের মা এবং খালেদা জিয়ার মা ছিলেন আত্মীয়। খালেদা জিয়ার ছোটবেলায় কোনো এক পারিবারিক সম্মিলনে তাকে দেখে মুগ্ধ হন জিয়াউর রহমান। পরে চিঠিতে তিনি খালেদা জিয়ার খোঁজখবর নিতেন বলেও জানা যায়। কর্মসূত্রে দিনাজপুর আসার পর তিনি খালেদা জিয়াকে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে জিয়াউর রহমানের বাবা মনসুর রহমান খালেদা জিয়ার ডিগ্রি পাশের পর বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে ছিলেন। 

পরে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছায় সম্মতি দেন বাবা মনসুর রহমান। তবে বিয়ের দিন তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। বিয়ের এক বছর আগে শাশুড়ি জাহানারা খাতুন মারা যান। 

মায়ের লাল বেনারসি শাড়ি পরে বিয়ে হয় খালেদা জিয়ার। বোন সেলিমা ইসলাম সেদিন বিউটিশিয়ানের কাজ করেন। খালেদা জিয়ার হাতে মেহেদি লাগানো ছাড়া অন্য প্রসাধনীর ব্যবহার ছিল না। খুবই সাদামাটা বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বিয়ের পর দিনাজপুরেই ছিলেন কয়েক বছর জিয়া-খালেদা দম্পতি। পরে তাঁরা পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে আসেন চট্টগ্রামে। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেন জিয়াউর রহমান। পরিবারের কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই তিনি যোগ দেন যুদ্ধে। ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। ওই সময়ও অকুতোভয় ছিলেন খালেদা জিয়া। 

জানা যায়, জিয়াউর রহমান ‘রিভোল্ট’ করার পর ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্র নিয়ে যেতে চায় পাকিস্তানি সৈনিকরা। আদেশ আনার জন্য হাবিলদার কাদেরের নির্দেশে সিপাহী নুরুল হক ছুঁটে যান সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়ার বাসায়। সেখানে জিয়া ছিলেন না। বেগম জিয়া জানতে চান, কী হয়েছে। ঘটনা শোনার পর খালেদা জিয়া পরিষ্কার নির্দেশ দেন, ‘মেজর জিয়ার হুকুম ছাড়া একটা সুঁইও ষোলশহর থেকে বাইরে যাবে না!’

নুরুল হক ছুঁটে গিয়ে কাদেরকে এ খবর জানান। ততক্ষণে বেলুচের সৈন্যরা অস্ত্র তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। কিন্তু বেগম জিয়ার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে হাবিলদার কাদের যখন বেলুচের গাড়িতে গুলি করার উদ্যোগ নেন, তখন বেলুচ সৈন্যরা সব অস্ত্র রেখে যায়। আর এর ফলে রক্ষা পায় ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের ১১০০ সৈন্য এবং মেজর জিয়া।

খালেদা জিয়ার ওই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না হলে পুরো ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট অস্ত্রহীন হয়ে পড়ত। এমনকি মেজর জিয়ার পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ত।

পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫-এর ঘটনাবহুল প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। এই সময়েও জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া দম্পতির সাধারণ জীবন-যাপনের দৃশ্য দেখা যায়। এরপর ১৯৮১ সালে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জিয়াউর রহমান। তারপর থেকে দুই সন্তান নিয়ে জীবনযাপন করেন খালেদা জিয়া। পরে বিএনপির হাল ধরেন তিনি। কয়েকবছর পরই শুরু হয় স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনে আপসহীন খেতাব পান খালেদা জিয়া। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, রাজপথে থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতায় পরিণত হন তিনি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নির্বাচনে। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। কিন্তু সাদামাটা জীবন দর্শন ভুলে যাননি। যে কারণে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও নিজস্ব সম্পদের দিকে তাঁর খেয়াল ছিল না। বড় ছেলে রাজনীতিতে এলেও তাকে কোনো সরকারি পদে বসাননি। 

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। দেশ পরিচালনার পাশাপাশি বারবার তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করেছেন। তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার তার দুই সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে মারা যান নির্বাসনে। তাদের সংসার আর কখনো এক ছাদের নিচে রাত্রিযাপনের সুযোগ পায়নি।

সর্বশেষ শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন তাঁর শরীরের ওপর যে নির্যাতন চালায়, সেই ধকল নিয়েই চলে গেলেন খালেদা জিয়া। তবে তাঁর যে মানবিকতা, দেশপ্রেম, দৃঢ় চারিত্রিক গুণাবলি, গভীরে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতা, সহনশীলতা— তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

খালেদা জিয়া কখনো মনে প্রতিহিংসা পুষে রাখতেন না। তিনি সবাইকে নিয়ে দেশ গড়তে চেয়েছেন। সেটাই ছিল তার দর্শন। কখনো এসবের প্রতিশোধ নিতে যাননি। তিনি জানতেন জনসমর্থনই তাঁর একমাত্র অবলম্বন। যার প্রমাণ পেয়েছেন, তিনি যখনই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, জিতেছেন। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন মহীয়সী নারী। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com