সংলাপের রাজনীতি কি বাংলাদেশে মৃত অধ্যায়?

সংলাপের রাজনীতি কি বাংলাদেশে মৃত অধ্যায়?
প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সংলাপ’ শব্দটি এখন যেন একপ্রকার বিলাসী উচ্চারণ। ক্ষমতা ও বিরোধিতার তীব্র মেরুকরণে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে শক্তি প্রদর্শন, আন্দোলন-প্রতিআন্দোলন এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে, সমঝোতা ও আলোচনার রাজনীতি কি বাংলাদেশে সত্যিই মৃত অধ্যায়, নাকি কেবল উপেক্ষিত?

সংলাপের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংলাপ একেবারে অনুপস্থিত ছিল, এ কথা বলা যাবে না। নব্বইয়ের গণআন্দোলন-পরবর্তী রাজনৈতিক সমঝোতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন কিংবা বিভিন্ন সময় জাতীয় সংকটে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে বৈঠক, সবই সংলাপের নজির। তবে এসব উদ্যোগ ছিল মূলত সংকট-নির্ভর ও সময়িক; প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংলাপকে রাজনীতির ধারাবাহিক অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি।

কেন সংলাপ ভেঙে পড়েছে?

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংলাপ কার্যত অচল হয়ে পড়ার পেছনে কয়েকটি কাঠামোগত কারণ রয়েছে-
প্রথমত, অতিরিক্ত ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণ-

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন একমুখীভাবে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। ক্ষমতাসীন পক্ষ আলোচনাকে দুর্বলতার প্রকাশ হিসেবে দেখে, আর বিরোধী পক্ষ সংলাপকে সময়ক্ষেপণ বা ‘ফাঁদ’ হিসেবে সন্দেহ করে।

দ্বিতীয়ত, পারস্পরিক অনাস্থা-

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের সংকট এতটাই গভীর যে, কোনো আলোচনাই টেকসই রূপরেখায় পৌঁছাতে পারে না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া সন্দেহ বর্তমানের সব উদ্যোগকে অকার্যকর করে দেয়।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়-

যুক্তির বদলে গালাগাল, প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা এবং শূন্য-সম ফলাফলভিত্তিক রাজনীতি সংলাপের জায়গা সংকুচিত করেছে।

সংলাপহীন রাজনীতির পরিণতি

সংলাপের অনুপস্থিতি সরাসরি প্রভাব ফেলছে রাষ্ট্র ও সমাজে। রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, সহিংসতা বাড়ছে, আর সাধারণ মানুষ রাজনীতি থেকে ক্রমশ বিমুখ হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ভারসাম্য রক্ষাকারীর ভূমিকা হারাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ও চাপ

বিশ্ব রাজনীতির অভিজ্ঞতা বলে, টেকসই গণতন্ত্রে সংলাপ অপরিহার্য। বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মহল বারবার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়েছে। তবে বাহ্যিক চাপ কখনোই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প হতে পারে না। সংলাপ চাপের কারণে নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থেই হওয়া উচিত।

সংলাপ কি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে?

সংলাপের রাজনীতি মৃত নয়, বরং তা নিবিড় পরিচর্যার অভাবে নিস্তেজ ।

এর পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজন কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন-

  • সংলাপকে ব্যক্তি বা দলের সদিচ্ছার ওপর না রেখে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আনতে হবে

  • নির্বাচনী ও সাংবিধানিক ইস্যুতে ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে

  • রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতার সুযোগ দিতে হবে

  • রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, সমঝোতা দুর্বলতা নয়, বরং রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা

উপসংহার

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপের মৃত্যু হয়নি; হয়েছে তার নির্বাসন। এই নির্বাসন যত দীর্ঘ হবে, রাজনৈতিক সংকট তত গভীর হবে। গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত হলো মতভিন্নতার মধ্যেও কথা বলার সক্ষমতা। সেই সক্ষমতা ফিরিয়ে আনাই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সংলাপ ছাড়া রাজনীতি টিকে থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র টিকে থাকে না এই সত্য উপলব্ধি করাই আজ সবচেয়ে |

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com