দলীয় সংস্কার বনাম ব্যক্তি-নির্ভর রাজনীতি: বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান চিত্র

দলীয় সংস্কার বনাম ব্যক্তি-নির্ভর রাজনীতি: বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান চিত্র
প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কাঠামোর শক্তি বনাম নেতা-কেন্দ্রিক ব্যক্তিত্বের প্রাধান্য, এই দ্বন্দ্বের মধ্যে এগিয়ে চলছে। রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হওয়া উচিত, যেখানে নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নেতা নির্বাচন সবকিছু প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ও স্বচ্ছ হয়। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত প্রভাব অনেক সময় দলের কাঠামোর ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে, যা রাষ্ট্র পরিচালনা ও গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

ব্যক্তিত্বের শক্তি বনাম দলীয় কাঠামো:

বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামো প্রায়শই নেতার ব্যক্তিত্বের চারপাশে ঘুরে। এই ধরনের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ কমে না, বরং দলীয় আলোচনার সুযোগ সংকুচিত হয়। ফলে সিদ্ধান্তগুলো হয়ে ওঠে একমুখী, যেখানে নীতি নয়, বরং নেতা-কেন্দ্রিক স্বার্থ প্রাধান্য পায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন বা নীতিমালার ক্ষেত্রে দলের নেতৃত্বের ইচ্ছার বাইরে খুব কম পরিমাণে সদস্যদের মত গ্রহণ করা হয়। এটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলে এবং দলীয় স্বচ্ছতা কমিয়ে দেয়।

সংবিধান ও প্রতিষ্ঠান: ব্যক্তি প্রভাবের খেলা:

রাজনীতিতে ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতার বৃদ্ধি প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে। সংসদ, স্থানীয় সরকার, বিচার বিভাগ,

সব ক্ষেত্রে ব্যক্তি-নির্ভর প্রভাব দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি বা দলীয় পদবিন্যাসে নেতার ব্যক্তিগত পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ও নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ক্ষুণ্ণ হয়।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব:

দলীয় সংস্কার না থাকলে সমাজও প্রভাবিত হয়। ভোটাররা নেতা-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং দলীয় নীতি সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করে। এটি রাজনৈতিক অংশগ্রহণে হ্রাস আনে, মতবিনিময় সীমিত করে এবং সামাজিক বিভাজন বাড়ায়। একইসঙ্গে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সংকোচন ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিলম্ব দেখা যায়।

সমাধান: দলীয় সংস্কার কতটা সম্ভব?

দলীয় সংস্কার সহজ নয়, তবে টেকসই গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।

এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে-

অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা :

নেতা নির্বাচন ও পদবিন্যাসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

শৃঙ্খলা ও দায়িত্ব ভাগাভাগি :

সিদ্ধান্তগ্রহণে একাধিক স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

সংলাপ ও মতবিনিময় বাড়ানো :

বিরোধী মত গ্রহণযোগ্য করে দলীয় শক্তি বৃদ্ধি করা।

যেমন, সম্প্রতি একটি দলীয় কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনে দলীয় ফোরামের চেয়ে নেতা-কেন্দ্রিক সিদ্ধান্তকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিভাজন দেখা গেছে। এটি স্পষ্ট করে যে, ব্যক্তি-কেন্দ্রিক রাজনীতি না শুধু দলকে দুর্বল করে, বরং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে।



উপসংহার:

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলীয় সংস্কার বনাম ব্যক্তি-নির্ভর রাজনীতি, এই দ্বন্দ্ব এখনো তীব্র। রাষ্ট্র যদি স্থিতিশীল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক পথে এগোতে চায়, তবে দলকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে প্রাধান্য দেওয়া, অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং নেতা-কেন্দ্রিক রাজনীতি হ্রাস করা অপরিহার্য। এর ব্যর্থতা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতি তখনই টেকসই হবে যখন নেতা নয়, দল ও প্রতিষ্ঠান প্রধান অবস্থানে থাকবে, এবং সমঝোতা, সংলাপ ও শৃঙ্খলা রাজনীতির মূল ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com