

Channel i
গণতন্ত্রের মূল দর্শন বলে, একজন নাগরিক, একটি ভোট, একটি সমান অধিকার। কিন্তু বাস্তব রাজনীতির মাঠে সেই সমীকরণ কতটা অটুট? প্রশ্নটা আজ আরও জোরালো হয়ে উঠছে, কারণ নির্বাচন মানেই এখন শুধু জনপ্রিয়তা বা জনসমর্থনের প্রতিযোগিতা নয়; এটি ক্রমেই পরিণত হচ্ছে অর্থ, প্রভাব ও ক্ষমতার জটিল খেলায়।
অর্থ ও নির্বাচনের অদৃশ্য যোগসূত্র
একটি নির্বাচনে অংশ নিতে এখন প্রার্থীর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কী—জনসম্পৃক্ততা, নৈতিকতা, না আর্থিক সক্ষমতা? বাস্তবতা বলছে, অর্থনৈতিক শক্তি ছাড়া টিকে থাকাই কঠিন।
প্রচারণা, পোস্টার, ব্যানার, ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, কর্মী ব্যবস্থাপনা, যানবাহন, নির্বাচনী এজেন্ট, সব মিলিয়ে নির্বাচন এখন একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত বা তৃণমূল থেকে উঠে আসা সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব এই প্রতিযোগিতায় শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে।
ধনীদের রাজনীতিতে প্রবেশ: প্রতিনিধিত্বের সংকট
নির্বাচনে অর্থের প্রভাব বাড়ার সরাসরি ফল হলো—ধনী শ্রেণির আধিপত্য। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কিংবা পুঁজিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজনীতিতে সহজে জায়গা করে নিচ্ছেন। এতে সংসদ বা জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের প্রতিফলন হারাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে—যারা নিজেরাই ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করেন, তারা কতটা আন্তরিকভাবে শ্রমজীবী, কৃষক, নিম্নআয়ের মানুষের স্বার্থ তুলে ধরতে পারবেন?
অঘোষিত বিনিয়োগ ও প্রত্যাশার রাজনীতি
নির্বাচনী ব্যয় শুধু নির্বাচনের দিনেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় এটি একটি ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে দেখা হয়—যার প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশিত হয় ক্ষমতায় গিয়ে। ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার পর নীতিনির্ধারণে জনস্বার্থের বদলে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়।
এখানেই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিপদ, রাষ্ট্রনীতি ধীরে ধীরে পুঁজির ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে।
রাজনৈতিক দলের দায় ও ভূমিকা
অর্থের এই আধিপত্য শুধু ব্যক্তির কারণে নয়; রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরের কাঠামোও দায় এড়াতে পারে না। দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় জনপ্রিয়তা বা কর্মের চেয়ে আর্থিক সক্ষমতা বেশি গুরুত্ব পায়। এতে রাজনীতিতে আদর্শিক কর্মী নয়, বরং অর্থশালী প্রার্থী উৎসাহিত হয়।
ফলাফল- দলের ভেতরে দীর্ঘদিন কাজ করা ত্যাগী কর্মীরা প্রান্তিক হয়ে পড়েন।
ভোটার ও অর্থের সম্পর্ক: নীরব বাস্তবতা
নির্বাচনী রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব ভোটার আচরণেও ছাপ ফেলে। কোথাও কোথাও নির্বাচনের সময় অর্থ, উপহার বা সুবিধা ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। যদিও সবাই এতে প্রভাবিত হয় না, কিন্তু এই সংস্কৃতি ভোটের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে।
ভোট তখন আর রাজনৈতিক মতের প্রকাশ থাকে না; হয়ে ওঠে সাময়িক লেনদেনের অংশ।
সমাধানের পথ: নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথ একেবারে নেই, এমন নয়। কিছু বিষয় জরুরি হয়ে উঠছে-
নির্বাচনী ব্যয়ের কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সীমা
দলীয় মনোনয়নে স্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র
নির্বাচনী ব্যয়ের কঠোর নজরদারি
ভোটারদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- রাজনীতিকে আবারও নৈতিকতার জায়গায় ফিরিয়ে আনার সামাজিক চাপ।
উপসংহার
নির্বাচনী রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের চরিত্র বদলে যাবে নিঃশব্দে। ক্ষমতা তখন জনগণের হাতে নয়, বরং ধীরে ধীরে সরে যাবে অর্থশালীদের নিয়ন্ত্রণে।
তবু আশার জায়গা এখানেই, গণতন্ত্র এখনো সংখ্যার শক্তিতে বিশ্বাস করে। প্রশ্ন শুধু একটাই, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কি নিজেদের ভোটের মূল্য বুঝে তা রক্ষা করতে পারবে?