দ্রুত নির্বাচন নাকি প্রতিষ্ঠান সংস্কার—সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি
রাজধানীর রাজনৈতিক চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস- একটাই তর্ক এখন সবার মুখে মুখে: নির্বাচন আগে, নাকি সংস্কার আগে?
দেশ যেন দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল প্রশ্নের মুখে।
যে পথেই যাওয়া হোক, তার প্রভাব পড়বে আগামী অন্তত এক দশকের রাজনীতিতে।
একদিকে দ্রুত নির্বাচনের চাপ, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা- এই দুই টানাপোড়েনে চলছে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি।
সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করছে:
“ভোট ছাড়া চলবে না, কিন্তু আস্থা ছাড়া ভোট কিভাবে হবে?”
যে কারণগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবি জোরালো করছে-
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বহু অংশ, বিশেষ করে দলগুলো, দ্রুত নির্বাচনের প্রতি ঝুঁকছে।
তাদের যুক্তি সহজ-
রাষ্ট্রের বৈধতা তৈরি হয় জনগণের ভোটে। সেই ভোট যত দেরি হবে, দেশ তত অনিশ্চয়তায় ডুবে থাকবে।
গণতান্ত্রিক শূন্যতা পূরণের প্রয়োজন-
একটি দেশের রাজনৈতিক যাত্রা ধীর হলেও দিকনির্দেশনা থাকতেই হয়।
নির্বাচন না হলে সেই দিকনির্দেশনাই অনিশ্চিত থাকে। সেখানেই দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে অনেকেই।
অর্থনীতি ও স্থিতির প্রশ্ন-
বাজার থেকে শুরু করে বিনিয়োগ—সবকিছুই রাজনীতির উপর নির্ভরশীল।
দ্রুত নির্বাচন হলে অন্তত দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহের সামনে একটি স্থির ভবিষ্যৎচিত্র দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যেমন বিনিয়োগ কমায়, তেমনি ভোগান্তি বাড়ায় সাধারণ মানুষের।
আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা-
প্রতিটি রাষ্ট্র তার বৈশ্বিক অবস্থান ঠিক রাখতে চায়।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন অনেকাংশেই নির্ভর করছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দ্রুত আয়োজনের ওপর।
কেন অনেকে বলছে- সংস্কার ছাড়া ভোট হলে সমস্যা কমবে না, বাড়বেঃ
এই দাবির বিপরীতে রয়েছে আরেকটি শক্তিশালী মত-
“নির্বাচন হবে, কিন্তু সেই নির্বাচন কতটা বিশ্বাসযোগ্য?”
এটাই এখন বিতর্কের কেন্দ্রে।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার প্রশ্ন-
কোনো নির্বাচন যতই জাঁকজমকপূর্ণ হোক, আস্থা না থাকলে তার মূল্য কমে যায়।
নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী—এই তিনটি স্তরের ওপর জনগণের বিশ্বাস নিশ্চিত না হলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা কঠিন।
আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থা-
নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয় আদালত, আইন, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার—এই সব উপাদানের সমন্বয়ে।
এগুলোর কোনোটি যদি পক্ষপাতদুষ্ট বা দুর্বল থাকে, তবে ভোট আর গণতন্ত্রের ব্যবধান বাড়ে, কমে না।
সমান রাজনৈতিক মাঠের প্রয়োজন-
যে রাষ্ট্রে একটি দল সুবিধাজনক অবস্থায়, আর আরেকটি দল চাপের মুখে—সেই নির্বাচনের ফল যতই “ঠিকঠাক” হোক, জনগণের মনে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এই বাস্তবতায় আগে রাজনৈতিক সমমাঠ তৈরির দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
মানুষের অনুভূতি-
“দুটোই দরকার, কিন্তু একইসঙ্গে করা সম্ভব কি?”
পরিস্থিতি যত জটিল হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মনোভাব তত বাস্তবসম্মত হয়ে উঠছে।
নাগরিকদের কথায় শোনা যায়-
“দ্রুত নির্বাচন দরকার, দেশ থিতু হবে। কিন্তু কমপক্ষে কিছু মৌলিক সংস্কারও তো দরকার-ভোটে আস্থা ফেরানোর জন্য।”
অর্থাৎ, জনগণের প্রত্যাশা কোনো একপাক্ষিক সমাধান নয়- বরং ভারসাম্যপূর্ণ পথ।
সংস্কারের ন্যূনতম কাঠামো
নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা বাড়ানো
প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভাব কমানো
নিরাপত্তা বাহিনীর কাজে স্বচ্ছতা
রাজনৈতিক দলের স্বাধীন প্রচারের সুযোগ
সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ কমানো
এসব ন্যূনতম সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে নির্বাচনও নিকটে আনা সম্ভব।
রাজনীতির বাস্তব প্রেক্ষাপট-
রাজনীতি কখনো শূন্যে চলে না।
সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় একদিকে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চস্বর, অন্যদিকে জনগণের আস্থার সংকট।
এভাবে দুই চাপের মাঝেই নতুন রাজনৈতিক সূত্র খোঁজা হচ্ছে।
শেষের ভাবনা,সন্ধিক্ষণ থেকে উত্তরণের পথ-
বাংলাদেশ আজ সেই অবস্থায় আছে যেখানে একটি ভুল সিদ্ধান্ত আগামী দিনগুলোকে আরো জটিল করে দিতে পারে।
তাই সিদ্ধান্তও হতে হবে বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং সর্বোপরি জনগণের আস্থা-ভিত্তিক।
সারমর্ম একটাই-
দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন; তবে তার আগে ন্যূনতম সংস্কার নিশ্চিত করা জরুরি।
নির্বাচন দেরি হলে অস্থিরতা বাড়বে, আর সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে সন্দেহ বাড়বে।
রাজনীতির সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এখন- এই দুইয়ের ভারসাম্য খুঁজে বের করা।
