রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য- জোনায়েদ সাকি

মুক্তিকামী সামাজিক গণতন্ত্রের লড়াইয়ের প্রত্যয় নিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের ৫ম জাতীয় সম্মেলন শুরু
রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য- জোনায়েদ সাকি
প্রকাশিত

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, আমরা এই দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ ও তাদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করি। আমরা চাই, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নাগরিক মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরি হবে। শ্রেণিগত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানবজাতি যে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে, সেই স্বপ্ন আমরা কার্যকর করতে চাই। আমরা বিশ্বাস রাখি, এদেশের মানুষ সারা দুনিয়ার মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে এই সমাজ নির্মাণ করতে পারবে। সেই কারণে, আমরা মুক্তিকামী সামাজিক গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করি।

আজ ৩১ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে গণসংহতি আন্দোলনের ৩ দিন ব্যাপী ৫ম জাতীয় সম্মেলনের ১ম দিনের উদ্বোধনী সমাবেশের সভাপতির বক্তব্যে এই কথা বলেন তিনি।

শ্রমিক-কৃষক, খেটে খাওয়া, নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের ন্যায্য হিস্যা চাই-এই দাবি নিয়ে এবং "বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ, অধিকার ও মর্যাদার বাংলাদেশ, জনগণের বাংলাদেশ" গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে শুরু হওয়া গণসংহতি আন্দোলনের ৫ম জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন শহীদ উমর নুরুল আফসারের স্ত্রী ফারজানা আক্তার রানী ও শহীদ মো. নাজমুল কাজীর স্ত্রী মারিয়া সুলতানা । সারা দেশ থেকে আগত কাউন্সিলর ও পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণে সম্মেলন চলবে আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত।

সমাবেশে জোনায়েদ সাকি বলেন, এই দেশে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায্য হিস্যার ব্যবস্থা নেই। সম্পদের বণ্টন কতিপয় মুষ্টিমেয় দখলদারের হাতে থাকে। ভোট রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি, কিন্তু গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট নয়। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো যদি জনগণের স্বার্থ নিয়ে, দেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের স্বার্থ নিয়ে তৈরি না হয়; যদি নীতি তৈরি না হয়; যদি সম্পদের বণ্টনের নীতি তৈরি না হয়; যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা তৈরি না হয়; যদি মানুষে মানুষে বৈষম্যের অবসান না হয় - তাহলে এই গণতন্ত্র টেকে না। গণতন্ত্র তখন মুষ্টিমেয়র হাতিয়ারে পরিণত হয়। তারা গণতন্ত্রকে দ্রুততম সময়ে কবর দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এর প্রমাণ রেখে গেছে।

জোনায়েদ সাকি আরও বলেন, এই কারণে আমরা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা সবকিছুর পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেছি। ১৯৭১ সালে লক্ষ শহীদ রক্ত দিয়ে যে রাষ্ট্র পত্তন করেছেন, ৭২ সালে সেই রাষ্ট্র শহীদদের আকাঙ্ক্ষা - সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার- অনুসারে গড়ে ওঠেনি। ৭২ সালে যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল সেই সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো শাসকদের স্বৈরতন্ত্রী হতে সাহায্য করে। সমস্ত রাষ্ট্রশক্তিকে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। ২৪ সালে এদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে, এই দেশের শাসনকাঠামো ও ক্ষমতাকাঠামো যেটা সংবিধানে আছে, সেটা দিয়ে বাংলাদেশ আর এগোতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি এদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই চব্বিশের তরুণরা, আমাদের দেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সকলে মিলে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে নতুন করে হাজির করেছেন। এই বাংলাদেশ হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।

তিনি আরও বলেন, জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্ট ছাড়া সংবিধান বদলায় না। জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্ট ছাড়া কোনো সংস্কার টেকসই হয় না। কাজেই সংস্কারকে বাস্তবায়ন করার জন্য নির্বাচন লাগবে। এই সংস্কারে গণসংহতি আন্দোলনের কোনো নোট অফ ডিসেন্ট নাই বললেই চলে। কারণ, আমরা সংস্কারের প্রস্তাবগুলো হাজির করেছি। কিন্তু আমরা একইসাথে এটাও বলেছি, অভ্যুত্থান একটা সম্মিলিত সংগ্রাম ছিল। কাজেই কোনো একটি একক দল যদি রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়, সেটা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সেটা সংঘাতের সৃষ্টি করবে। আর এই সংঘাতের জায়গা দিয়ে পতির ফ্যাসিস্টরা ও তাদের দেশি-বিদেশি মিত্ররা আর শেখ হাসিনা ভারতে বসে আজকে এই অভ্যুত্থানের অর্জনকে ধ্বংস করতে চাইবে। আমাদের এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা ঠিক হবে না, এমন একটা জায়গা তৈরি করে দেওয়া, যেখানে ফ্যাসিস্টরা আবার প্রবেশ করতে পারে। সেজন্য দরকার ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য। ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া আমরা এই রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটাতে পারবো না।

সমাবেশে সূচনা বক্তব্যে গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, গণসংহতি আন্দোলনের একমাত্র গর্ব হচ্ছে, গণসংহতি কখনো ইতিহাসের ডাক অস্বীকার করে নাই। ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে জনগণের মুক্তির জন্য যখনই সংগ্রামের ডাক এসেছে, গণসংহতি আন্দোলনের নেতাকর্মী সকলেই সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

আবুল হাসান রুবেল আরও বলেন, আমরা মুক্তিকামী সামাজিক গণতন্ত্রের কথা বলি। আজকে পৃথিবীতে যেধরনের নতুন ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছে তার বিপরীতে সারা দুনিয়াতেই নতুন রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ ছিল ভারতের বিজেপির ফ্যাসিবাদের একটা রূপ। আজকে বাংলাদেশের ভেতরেই যে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটার সুযোগ আছে, সেটার বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎমুখী ঐক্যবদ্ধ নতুন রাজনীতি গড়ে তোলা দরকার।

গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য প্রখ্যাত কৃষকনেতা দেওয়ান আব্দুর রশিদ নীলু বলেন, গণসংহতি আন্দোলনের দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় শহীদ জুলফিকার শাকিলসহ অনেককে আমরা হারিয়েছি। তাদেরকে আমরা আজ এই সম্মেলনের দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের তালিকা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, আহতদের সুচিকিৎসা এবং শহীদ ও আহতদের পরিবারের জীবনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আখতার বলেন, সকলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। এই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে আমরা একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি চাই। জনগণের সকল অংশের প্রতিনিধি আমরা জাতীয় সংসদে দেখতে চাই। জনগণের অধিকাংশ খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের অধিকার এই বাংলাদেশে নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই চলবে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চব্বিশের জুলাইয়ে সারা দেশের তরুণরা নেমে এসেছেন। আমি বিশ্বাস করি ন্যায়ের জয় হবেই, সত্যের জয় হবেই।

তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকার যে সংকট তৈরি করেছে, তা কেটে যাবে। বিভিন্ন দল বা মত থাকলেও আমরা বাংলাদেশের ব্যাপারে একমত, সবার আগে বাংলাদেশ। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, যা হবার হয়ে গেছে। দয়া করে সব সমস্যার সমাধান করে আমরা যাতে নির্বাচন আয়োজন করতে পারি, কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারি, সেজন্য আসুন একসাথে কাজ করি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ক্ষমতায় যারা আছে তারা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রতারণা করে তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? তিনি বলেন, দেশকে রক্ষা করবার দায়িত্ব এখন আপনাদের আমাদের সকলের। একটা নতুন বাংলাদেশ যারা গড়তে চান, যারা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন, যারা সারা দেশে কাজ করছেন সকলের দায়িত্ব এই বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদ থেকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য একটা গুণগত মানসম্পন্ন নির্বাচন করতে হবে।

সমাবেশে ভিডিও বক্তব্য রাখেন দৃকের প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহীদুল আলম এবং আরও বক্তব্য রাখেন বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, আমার বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের সংগঠক প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসিবুদ্দীন হোসেন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানাসহ জাতীয় ও দলের নেতৃবৃন্দ এবং অতিথিবৃন্দ।

সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ফিরোজ আহসান, নাজার আহমেদ, কেরামত আলী, রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য ফিরোজ আহমেদ, হাসান মারুফ রুমী, মনির উদ্দিন পাপ্পু, কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য বাচ্চু ভূইয়া, দীপক রায়, অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ, কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য আমজাদ হোসেন, আলিফ দেওয়ান, মিজানুর রহমান, অঞ্জন দাস, সৈকত মল্লিক, উবা থুয়াই মারমা, নারী সংহতির সভাপ্রধান শ্যামলী শীল, সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা দেব, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহীম চৌধুরী, বাংলাদেশ কৃষক মজুর সংহতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম, বাংলাদেশ যুব ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ সুজন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড, সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফসহ বিভিন্ন জেলা/মহানগর, উপজেলা ও থানার নেতৃবৃন্দ।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com