ছাত্র রাজনীতি: সংকট, পুনর্গঠন ও ভবিষ্যতের রূপরেখা

ছাত্র সংগঠনগুলো এখন প্রকৃত ছাত্র অভিন্নতায় নয়, মূলধারার রাজনৈতিক দলের ‘এজেন্ডা’ নিয়েই বেশি সক্রিয়
ছাত্র রাজনীতি: সংকট, পুনর্গঠন ও ভবিষ্যতের রূপরেখা
প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের যাত্রাপথে ছাত্র রাজনীতি একসময় ছিল নৈতিক শক্তির প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অগ্রভাগের জনতা। আজ সেই একই ছাত্ররাজনীতি নানা প্রশ্নের মুখোমুখি—তার আদর্শ কোথায়, নেতৃত্ব কোথায় এবং ভবিষ্যৎ কোন পথে? এই সন্ধিক্ষণেই ছাত্র রাজনীতিকে নতুন করে বুঝতে হয়: এর বর্তমান সংকট কোথায়, ভূমিকার সীমাবদ্ধতা কী, আর পুনর্গঠনের সম্ভাবনা কতটা বাস্তব?

বর্তমান প্রেক্ষাপট: রূপ বদলের অভিঘাত-

১. দলীয়করণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণঃ

বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা কলেজ—ছাত্র সংগঠনগুলো এখন প্রকৃত ছাত্র অভিন্নতায় নয়, মূলধারার রাজনৈতিক দলের ‘এজেন্ডা’ নিয়েই বেশি সক্রিয়। এ কারণে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যা থেকে বাস্তব রাজনীতি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।


২. ক্যাম্পাস-কেন্দ্রিক আধিপত্য রাজনীতিঃ

আবাসিক হলের নিয়ন্ত্রণ, সিট ব্যবস্থাপনা, শক্তি প্রদর্শন—এই সবই এখন ছাত্র রাজনীতির নিত্যচর্চা। যে প্ল্যাটফর্ম নাগরিক নেতৃত্ব গড়ার কথা, সেটাই অনেক সময় ক্ষমতার প্রতিযোগিতার মাঠে পরিণত হয়েছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তাহীনতা ও বিতৃষ্ণায় ভুগছে।


৩. আন্দোলনের ভাষা বদলে যাওয়াঃ

অতীতে আন্দোলন মানেই ছিল জনস্বার্থের প্রশ্ন—মুক্ত হতে চাইলে বাধা ছিল রাষ্ট্রশক্তি। এখন আন্দোলন মানেই দলীয় শক্তির টানাপোড়েন, যেখানে শিক্ষাকেন্দ্রিক অবস্থা, শিক্ষার মান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মতো গভীর প্রশ্নগুলো গৌণ হয়ে গেছে।

ভূমিকা: সংকীর্ণতার মাঝেও অপরিহার্যতা-

১. নীতি প্রণয়নে তরুণ চাপ গ্রুপ

যতই সমালোচনা থাকুক, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ছাত্র আন্দোলন এখনও শক্তিশালী এক চাপগ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বৃদ্ধি, সেশনজট, নিরাপত্তা, যৌন হয়রানি—এসব ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের একত্রিত হওয়াই পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়।


২. ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ‘ইনকিউবেটর’

ছাত্র রাজনীতিকে ভুলে গেলে চলে না—এটি এখনও নেতৃত্ব তৈরি করে। সংগঠন পরিচালনা, আলোচনা পরিচালনা, মাঠে বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবিলা—এই অভিজ্ঞতা তরুণদের রাজনৈতিক দক্ষতার প্রথম সূত্র।


৩. সামাজিক ন্যায়বিচারের দ্রুত প্রতিক্রিয়া বাহিনী

বাংলাদেশে বড় কোনো সামাজিক ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে দ্রুত সংগঠিত হয় ছাত্রসমাজ। পরিবেশ, দুর্নীতি, মানবাধিকার—এ সব ক্ষেত্রেই ছাত্রসমাজের ভূমিকা অন্য শক্তিদের তুলনায় বেশি আকস্মিক, বেশি তীক্ষ্ণ।

ভবিষ্যৎ: ছাত্র রাজনীতির পুনর্জাগরণের পথরেখা

১. ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজমের উত্থান- নতুন নেতৃত্বের জন্ম

একসময় ক্যাম্পাস ছিল ছাত্র রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র; এখন অনলাইন স্পেসেই নতুন নেতৃত্ব জন্ম নিচ্ছে। নীতি-আলোচনা, মতপ্রকাশ, সংগঠিত ক্যাম্পেইন—সবকিছুই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চৌকস তরুণদের একত্র করছে। ভবিষ্যতের রাজনীতি এই নতুন ডিজিটাল-সচেতন প্রজন্মের হাতেই গড়ে উঠতে পারে।


২. শিক্ষার্থীর দাবি-কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রত্যাবর্তন

সাম্প্রতিক কয়েক বছর শিক্ষাকেন্দ্রিক আন্দোলনের পুনরুত্থান দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন সঙ্কট—আবাসন, নিরাপত্তা, মানসম্মত শিক্ষা—এসবের ওপর চাপ বাড়ছে। ছাত্র সংগঠনগুলো টিকে থাকতে হলে তাদের ইস্যুতে ফেরা ছাড়া বিকল্প নেই।


৩. সহিংসতামুক্ত রাজনীতির চাহিদা বৃদ্ধি

যে সমাজ ক্রমেই তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর, দ্রুতগতির ও বিশ্বায়িত হচ্ছে, সেখানে সহিংস রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয়। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী—সবাই এখন সহিংসতা বর্জিত ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। এই চাপ ভবিষ্যতে নেতৃত্বের স্বর ও আচরণ বদলে দিতে বাধ্য করবে।

উপসংহার: একটি প্রয়োজনীয় পুনর্গঠন

ছাত্র রাজনীতি আজ স্থবিরতা ও চাপের মাঝেই নিজের পথ খুঁজছে। তবে এটি এখনও ভবিষ্যত নির্মাণের একটি অপরিহার্য ক্ষেত্র—যেখানে ন্যায়ের ভাষা, গণতন্ত্রের চর্চা এবং তরুণ নেতৃত্বের সাহসিকতা একত্রিত হতে পারে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com