বিরোধী কণ্ঠ দমনে আইন: নিরাপত্তা না নিয়ন্ত্রণ?

বিরোধী কণ্ঠ দমনে আইন: নিরাপত্তা না নিয়ন্ত্রণ?
প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্নগুলোর একটি হলো, বিরোধী কণ্ঠ দমনে ব্যবহৃত আইনগুলো আসলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, নাকি তা হয়ে উঠছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার? সাইবার আইন থেকে শুরু করে জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট নানা বিধান, সবই রাষ্ট্রের বৈধ ক্ষমতার অংশ। কিন্তু এসব আইনের প্রয়োগ যখন একমুখী ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন আইন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়েই গভীর সংকট তৈরি হয়।

আইনের প্রয়োজনীয়তা ও রাষ্ট্রীয় যুক্তি

রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে আইন প্রণয়নের যুক্তি স্পষ্ট- সন্ত্রাস দমন, গুজব প্রতিরোধ, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা ঠেকানো, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা। ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্য, উসকানিমূলক বক্তব্য কিংবা সহিংসতা উসকে দেওয়ার ঝুঁকি বাস্তব। তাই সাইবার অপরাধ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর আইন থাকা অস্বাভাবিক নয়।

সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন আইনের ভাষা অস্পষ্ট থাকে এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা অনুপস্থিত হয়। তখন ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি ঢাল হয়ে ওঠে, যার আড়ালে মতপ্রকাশ সীমিত হয়।

বিরোধী কণ্ঠ ও আইনের প্রয়োগ: বাস্তব চিত্র

বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ঘটনা নিয়মিত আলোচনায় আসে। অভিযোগের ধরন প্রায় একই, রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য, মানহানি, উসকানি বা গুজব ছড়ানো। কিন্তু এসব মামলার বড় অংশেই দ্রুত তদন্ত, ন্যায়সঙ্গত বিচার কিংবা চূড়ান্ত রায়ের স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।

এতে দুটি বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়-

ভয়ের সংস্কৃতি: মানুষ সমালোচনা এড়িয়ে চলে, আত্মনিয়ন্ত্রণ (self-censorship) বাড়ে

রাজনৈতিক বৈষম্য: একই অপরাধে এক পক্ষ শাস্তির মুখে পড়ে, অন্য পক্ষ থাকে প্রায় অচ্ছুত

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা

সংবিধান মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও তাতে ‘যুক্তিসংগত সীমাবদ্ধতা’র কথা বলা আছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই সীমাবদ্ধতা জরুরি, কিন্তু সেটি হতে হবে স্পষ্ট, আনুপাতিক ও প্রয়োজননির্ভর। যখন সীমাবদ্ধতা অস্পষ্ট ও অতিরিক্ত হয়, তখন তা স্বাধীনতার মূল সত্তাকেই ক্ষুণ্ণ করে।

আইনের উদ্দেশ্য যদি সত্যিই নিরাপত্তা হয়, তবে তার প্রয়োগে সমতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। অন্যথায় আইন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক শক্তির সম্প্রসারণ।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বাংলাদেশের অবস্থান

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামো, বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তিগুলো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই সঙ্গে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে এই অধিকার খর্ব করা যাবে না নির্বিচারে। বাংলাদেশ এসব চুক্তির অংশীদার হলেও বাস্তব প্রয়োগে সেই মানদণ্ড কতটা অনুসৃত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

আইনের রাজনৈতিক ব্যবহার: গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

যখন বিরোধী কণ্ঠ দমনে আইন নিয়মিত অস্ত্র হয়ে ওঠে, তখন গণতন্ত্র ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হারায়। সংসদ দুর্বল হয়, রাজপথ সহিংস হয়ে ওঠে, আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিণত হয় প্রশাসনিক লড়াইয়ে। এতে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ সমালোচনা ছাড়া শাসন মানেই নীতিগত অন্ধত্ব।

সমাধানের পথ কোথায়?

এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন-

  • আইনের ভাষা স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করা, যেন অপব্যবহারের সুযোগ কমে

  • আইনের প্রয়োগে সমতা নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে

  • বিচারিক তদারকি জোরদার করা, বিশেষ করে গ্রেপ্তার ও মামলার ক্ষেত্রে

  • মতপ্রকাশকে রাষ্ট্রের শত্রু নয়, শক্তি হিসেবে দেখা।

উপসংহার

বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কোনো রাষ্ট্র দীর্ঘদিন নিরাপদ থাকতে পারে না। নিরাপত্তা আসে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, আস্থাভিত্তিক শাসন ও ন্যায়সঙ্গত আইনের মাধ্যমে। আইন যদি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে তা নিরাপত্তা নয়, বরং ভবিষ্যৎ অস্থিরতার বীজ বপন করে। আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন তাই একটাই- আমরা আইনকে কি রাষ্ট্র রক্ষার উপায় বানাব, নাকি মতদমন করার অস্ত্র? এই প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত আছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com