ক্রিকেটের বাইরে বাংলাদেশ: আর্চারি, শুটিং ও অ্যাথলেটিক্সের নীরব সংগ্রাম

ক্রিকেটের বাইরে বাংলাদেশ: আর্চারি, শুটিং ও অ্যাথলেটিক্সের নীরব সংগ্রাম
প্রকাশিত

বাংলাদেশে খেলাধুলা বলতে এখনো প্রথমেই যে নামটি আসে, তা হলো ক্রিকেট। গ্যালারির উন্মাদনা, টেলিভিশনের লাইভ সম্প্রচার, করপোরেট স্পন্সর আর বিজ্ঞাপনের ঝলকানিতে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে জাতীয় আবেগের প্রতীক। অথচ এই আলো–ঝলমলে দৃশ্যের আড়ালে, নীরবে সংগ্রাম করে যাচ্ছে দেশের অন্য খেলাগুলো- বিশেষ করে আর্চারি, শুটিং ও অ্যাথলেটিক্স। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবার সম্ভাবনার জানান দিলেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, অবকাঠামো ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে এসব খেলা আজও ‘বিকল্প ক্রীড়া’ হিসেবেই রয়ে গেছে।

আর্চারি: সীমিত সম্পদে বড় স্বপ্ন-

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আর্চারির উত্থান একেবারেই ব্যতিক্রমী। অল্প সময়ের মধ্যেই এই খেলাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বকাপ, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা কমনওয়েলথ গেমসে আর্চারদের সাফল্য প্রমাণ করেছে, সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে ক্রিকেটের বাইরেও বাংলাদেশ সফল হতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সাফল্যের পেছনে কাঠামোগত শক্ত ভিত্তি এখনো গড়ে ওঠেনি। দেশের বাইরে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্যাম্প ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে আর্চারি প্রশিক্ষণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। অনেক আর্চারকে নিজের খরচে সরঞ্জাম কিনতে হয়, যা একটি দরিদ্র বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বড় বোঝা। আন্তর্জাতিক মানের তীর, ধনুক কিংবা প্রশিক্ষণ সুবিধা না থাকায় প্রতিভা অনেক সময় মাঝপথেই ঝরে পড়ে।

শুটিং: সম্ভাবনা আছে, আলো নেই-

শুটিং এমন একটি খেলা, যেখানে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা ঐতিহাসিকভাবেই সম্ভাবনার কথা শুনিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়া পর্যায়ে সাফল্য থাকলেও বিশ্বমঞ্চে ধারাবাহিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। এর অন্যতম কারণ অবকাঠামোগত সংকট।

শুটিং রেঞ্জের অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা এবং আন্তর্জাতিক মানের কোচিং না থাকায় শুটারদের প্রস্তুতি প্রায়ই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অনেক শুটার অভিযোগ করেন, প্রতিযোগিতার ঠিক আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়াকে ‘প্রস্তুতি’ বলা হলেও, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। উপরন্তু, নিরাপত্তা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই খেলাটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

অ্যাথলেটিক্স: ভিত্তি শক্ত, ফলাফল দুর্বল-

অ্যাথলেটিক্সকে বলা হয় সব খেলাধুলার ‘মা’। অথচ বাংলাদেশে এই খেলাটিই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। গ্রামগঞ্জে অসংখ্য তরুণ-তরুণীর দৌড়, লাফ বা নিক্ষেপে প্রাকৃতিক সক্ষমতা থাকলেও, তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না।

স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নিয়মিত প্রতিযোগিতার অভাব, মানসম্মত ট্র্যাকের সংকট এবং পুষ্টি ও মেডিক্যাল সাপোর্ট না থাকায় অ্যাথলেটরা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারে না। অনেক প্রতিভাবান অ্যাথলেট বয়সভিত্তিক পর্যায় পেরোতেই হারিয়ে যায়- কেউ পড়াশোনার চাপে, কেউ আর্থিক অনিশ্চয়তায়।

অর্থনীতি ও পৃষ্ঠপোষকতার বৈষম্য-

ক্রিকেটের সঙ্গে অন্যান্য খেলাগুলোর সবচেয়ে বড় পার্থক্য তৈরি করেছে অর্থনীতি। ক্রিকেট বোর্ডের কোটি কোটি টাকার বাজেটের বিপরীতে আর্চারি, শুটিং বা অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনগুলো চলে সীমিত অনুদানে। স্পন্সরদের আগ্রহও কম, কারণ এসব খেলায় তাৎক্ষণিক ‘রিটার্ন’ নেই।

ফলে খেলোয়াড়দের জন্য মাসিক ভাতা, উন্নত প্রশিক্ষণ কিংবা বিদেশে প্রস্তুতি ম্যাচ, সবই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অনেক ক্রীড়াবিদ জাতীয় দলে খেলেও জীবিকার নিশ্চয়তা পান না, যা দীর্ঘমেয়াদে খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ কমিয়ে দেয়।

নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনার সংকট-

বাংলাদেশের ক্রীড়ানীতিতে ক্রিকেটকেন্দ্রিকতা স্পষ্ট। অলিম্পিক বা কমনওয়েলথের মতো বহুজাতিক আসরে ভালো করার লক্ষ্য থাকলেও, সেই অনুযায়ী প্রস্তুতির রূপরেখা নেই। খেলাকে ‘ইভেন্টভিত্তিক’ দেখা হয়, বড় আসর এলেই তৎপরতা, তারপর আবার দীর্ঘ নীরবতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্চারি, শুটিং ও অ্যাথলেটিক্সে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন অন্তত ৮-১০ বছরের ধারাবাহিক পরিকল্পনা। কোচ তৈরি, খেলোয়াড়দের শিক্ষা ও পেশাগত নিরাপত্তা, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সবকিছু মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

আশার আলো কোথায়?-

সব সংকটের মাঝেও আশার জায়গা আছে। আর্চারির সাম্প্রতিক সাফল্য, তরুণ শুটারদের আন্তর্জাতিক মানের স্কোর কিংবা অ্যাথলেটিক্সে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই, পিছিয়ে আছে ব্যবস্থাপনায়।

যদি সরকার, ক্রীড়া ফেডারেশন ও বেসরকারি খাত সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসে, তবে ক্রিকেটের বাইরেও বাংলাদেশ একটি বহুমুখী ক্রীড়া শক্তিতে পরিণত হতে পারে।

উপসংহার-

ক্রিকেট নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গর্ব। কিন্তু একটি দেশের ক্রীড়া পরিচয় কখনো একটিমাত্র খেলায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আর্চারি, শুটিং ও অ্যাথলেটিক্সের নীরব সংগ্রাম আসলে আমাদের ক্রীড়ানীতির আয়না। এই আয়নায় তাকিয়ে যদি আমরা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে লাল-সবুজের পতাকা উড়বে শুধু ক্রিকেট মাঠে নয়, অলিম্পিক স্টেডিয়ামেও।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com