খেলাধুলা এখন বড় ব্যবসা: স্পন্সরশিপ, সম্প্রচার স্বত্ব ও অর্থনৈতিক রাজনীতি

খেলাধুলা এখন বড় ব্যবসা: স্পন্সরশিপ, সম্প্রচার স্বত্ব ও অর্থনৈতিক রাজনীতি
প্রকাশিত

এক সময় খেলাধুলা ছিল মূলত প্রতিযোগিতা আর বিনোদনের বিষয়। সর্বসাধারণের মনের খোরাক মেটানোর  এক সুস্থ মাধ্যম ছিলো খেলা দেখা। 

আজ তা রূপ নিয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়, যেখানে মাঠের ফলাফলের চেয়েও কখনো কখনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে স্পন্সরশিপ চুক্তি, সম্প্রচার স্বত্ব আর কর্পোরেট স্বার্থের হিসাব। বিশ্বজুড়েই খেলাধুলা এখন আর শুধু খেলা নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক ব্যবসা।

স্পন্সরশিপ: আবেগের বাজার

খেলাধুলার সবচেয়ে দৃশ্যমান ব্যবসায়িক রূপ স্পন্সরশিপ। একটি দল, টুর্নামেন্ট বা খেলোয়াড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ভক্তদের আবেগের বাজারে প্রবেশ করে। জার্সিতে লোগো, টুর্নামেন্টের নামের সঙ্গে ব্র্যান্ড যুক্ত হওয়া কিংবা স্টেডিয়ামের বিজ্ঞাপন, সবই একই কৌশলের অংশ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রিকেটই এই ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। বিপিএলের প্রতিটি মৌসুমে টাইটেল স্পন্সর, দলীয় স্পন্সর ও সম্প্রচার সহযোগীদের উপস্থিতি প্রমাণ করে, ক্রিকেট এখন করপোরেট বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্র। স্পন্সররা জানে, ক্রিকেট মানেই নিশ্চিত দর্শক, আর দর্শক মানেই ব্র্যান্ডের দৃশ্যমানতা।

কিন্তু এই নির্ভরতার একটি নেতিবাচক দিকও আছে। যে খেলাগুলো টেলিভিশন দর্শক টানে না, সেগুলো করপোরেট বিনিয়োগ পায় না। ফলে স্পন্সরশিপ অর্থনীতি ক্রিকেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, অন্য খেলাগুলো পড়ে থাকে উপেক্ষার তালিকায়।

সম্প্রচার স্বত্ব: খেলার আসল মুদ্রা

আধুনিক ক্রীড়া ব্যবসায় সম্প্রচার স্বত্বই সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি। খেলা যত বেশি দর্শকের ঘরে পৌঁছায়, তার বাণিজ্যিক মূল্য তত বাড়ে। টেলিভিশন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের যুগে এই স্বত্ব হয়ে উঠেছে লিগ ও বোর্ডগুলোর প্রধান আয়ের উৎস।

বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সিরিজ বা বিপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব ঘিরে বড় অঙ্কের বাণিজ্য হয়। সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে, আর বোর্ড সেই আয় দিয়ে পুরো ক্রিকেট কাঠামো চালায়। ফলে খেলার সময়সূচি, ভেন্যু নির্বাচন এমনকি ম্যাচের সময়ও অনেক সময় সম্প্রচার চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।

এখানেই শুরু হয় প্রশ্ন, খেলার সিদ্ধান্ত কি মাঠের স্বার্থে হচ্ছে, নাকি ক্যামেরার সুবিধার জন্য? রাতের ম্যাচ, টানা খেলা বা খেলোয়াড়দের বিশ্রামের ঘাটতি, সব কিছুর পেছনেই সম্প্রচার অর্থনীতির চাপ কাজ করে।

অর্থনীতির রাজনীতি: কে নিয়ন্ত্রণ করে খেলাধুলা

খেলাধুলার ব্যবসায়িকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রও বদলেছে। আগে ক্রীড়া সংগঠন ছিল মূল সিদ্ধান্তকারী। এখন সেই জায়গায় অনেক সময় করপোরেট স্পন্সর, সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক অংশীদারদের প্রভাব বাড়ছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। কোন টুর্নামেন্ট বেশি গুরুত্ব পাবে, কোন লিগ টিকে থাকবে, এমনকি কোন খেলোয়াড় বেশি আলো পাবে, এসব সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক বিবেচনা বড় ভূমিকা রাখে। এতে করে খেলাধুলা ধীরে ধীরে একটি বাছাই করা পণ্যে পরিণত হয়, যেখানে লাভের সম্ভাবনা নেই, সেখানে বিনিয়োগও নেই।

এই অর্থনৈতিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় দীর্ঘমেয়াদি ক্রীড়া উন্নয়নে। তৃণমূল, স্কুল স্পোর্টস বা অলিম্পিকধর্মী খেলাগুলো দ্রুত ফল দেয় না বলে ব্যবসার হিসাবেও গুরুত্ব পায় না।

খেলোয়াড়: পণ্যে রূপান্তরের ঝুঁকি

খেলাধুলা যখন ব্যবসা হয়, তখন খেলোয়াড়ও এক অর্থে সম্পদে পরিণত হয়। জনপ্রিয় খেলোয়াড় মানেই বেশি দর্শক, বেশি স্পন্সর, বেশি বিজ্ঞাপন। এতে করে তারকা নির্ভরতা বাড়ে, কিন্তু সাধারণ খেলোয়াড়রা পড়ে যায় অনিশ্চয়তায়।

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে দেখা যায়, চুক্তিভিত্তিক খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি বাজারমূল্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এতে খেলোয়াড়ের পেশাগত নিরাপত্তা কমে এবং মানসিক চাপ বাড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে খেলার মানের ওপর প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

খেলাধুলা আজ আর নিরেট আবেগের জায়গায় নেই। এটি অর্থনীতি, ব্যবসা ও ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। স্পন্সরশিপ ও সম্প্রচার স্বত্ব খেলাধুলাকে আর্থিক শক্তি দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে সৃষ্টি করেছে বৈষম্য ও নির্ভরতার নতুন বাস্তবতা।

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো- এই ব্যবসায়িক বাস্তবতার ভেতর থেকেও খেলাধুলার মৌলিক মূল্যবোধ ও বহুমুখী উন্নয়নকে বাঁচিয়ে রাখা। না হলে খেলাধুলা এগোবে ঠিকই, কিন্তু কেবল সেই দিকেই যেখানে লাভ আছে, যেখানে সম্ভাবনা আছে, সেখানে নয়।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com