প্রযুক্তির গতিতে আইন পিছিয়ে পড়ছে?

এআই, ডিপফেক ও সাইবার অপরাধ, কার হাতে নিয়ন্ত্রণ ?
প্রযুক্তির গতিতে আইন পিছিয়ে পড়ছে?
প্রকাশিত

প্রযুক্তির ইতিহাসে এমন সময় আগে কখনো আসেনি, যখন পরিবর্তনের গতি আইন প্রণয়নের গতিকে এত স্পষ্টভাবে ছাড়িয়ে গেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ডিপফেক, স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম ও সাইবার অপরাধ, সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ব আজ এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রযুক্তি প্রতিদিন নতুন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর আইন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছে।

বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক বাস্তবতার বাইরে নয়।

আইনের গতি বনাম প্রযুক্তির গতি

আইন সাধারণত অতীত অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু প্রযুক্তি কাজ করে উল্টোভাবে, সে ভবিষ্যৎ তৈরি করে, অনেক সময় কোনো সামাজিক প্রস্তুতি ছাড়াই। এআই বা ডিপফেক প্রযুক্তি যখন ব্যবহারকারীর হাতে পৌঁছায়, তখন সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়, এই সময়ের ব্যবধানেই জন্ম নেয় সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিধান বা তথ্যপ্রযুক্তি আইনগুলো মূলত মানব-নিয়ন্ত্রিত অপরাধের কাঠামোতে তৈরি। অথচ এআই-নির্ভর অপরাধে অপরাধী অনেক সময় মানুষ নয়, বরং একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম, যার দায় নির্ধারণ করা আইনগতভাবে জটিল।

ডিপফেক: বাস্তব আর মিথ্যার সীমা ভাঙছে

ডিপফেক প্রযুক্তি এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। ভিডিও বা অডিও প্রমাণ যেখানে একসময় সবচেয়ে শক্তিশালী সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হতো, সেখানে এখন চোখে দেখা বা কানে শোনাও আর নিশ্চিত সত্য নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিপফেকের ঝুঁকি কয়েকটি স্তরে স্পষ্ট-

  • রাজনৈতিক চরিত্র হনন

  • নারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা

  • সামাজিক অস্থিরতা ও গুজব

  • প্রমাণ জালিয়াতির মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা বিভ্রান্ত করা

আইন এখানে প্রশ্নের মুখে পড়ে, ডিপফেক তৈরি করা অপরাধ, নাকি তা ছড়িয়ে দেওয়া অপরাধ? আর এআই যদি নিজে নিজেই কনটেন্ট তৈরি করে, দায় কার?

এআই ও দায়বদ্ধতার সংকট

এআই এখন শুধু টুল নয়; অনেক ক্ষেত্রে সে সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্লেষণ করে, এমনকি মানুষের আচরণ অনুমান করে। ব্যাংকিং, নিয়োগ, নজরদারি, স্বাস্থ্যসেবা, সব জায়গায় এআই ঢুকে পড়েছে।

কিন্তু সমস্যা হলো-

  • এআই ভুল করলে দায় কার?

  • ডেটা বায়াস থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে?

  • স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তে মানবিক বিবেচনার জায়গা কোথায়?

বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন কাঠামোতে অ্যালগরিদমিক দায়বদ্ধতা নামে কোনো সুস্পষ্ট ধারণাই নেই। ফলে প্রযুক্তির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নাগরিকের আপিল করার সুযোগ সীমিত।

সাইবার অপরাধ: সীমান্তহীন অপরাধ, সীমাবদ্ধ আইন

সাইবার অপরাধের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর সীমান্তহীনতা। একটি অপরাধ হতে পারে-

  • সার্ভার অন্য দেশে

  • অপরাধী তৃতীয় দেশে

  • ভুক্তভোগী বাংলাদেশে

এই বাস্তবতায় জাতীয় আইন প্রয়োগ অনেক সময় কার্যকর হয় না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, তথ্য আদান-প্রদান ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ছাড়া সাইবার অপরাধ দমন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? রাষ্ট্র, প্রযুক্তি নাকি কর্পোরেট শক্তি

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এখানেই, এই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে?

  • রাষ্ট্র আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়

  • প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেরাই নিয়ম বানায়

  • ব্যবহারকারীরা অনেক সময় ঝুঁকি না বুঝেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে

ফলে একটি ক্ষমতার ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে, যেখানে আইন সবচেয়ে ধীর গতির খেলোয়াড়। এই অসম প্রতিযোগিতায় নাগরিকের অধিকার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে।

সমাধান কোথায়?

সমাধান প্রযুক্তিকে থামানো নয়, তা সম্ভবও নয়। সমাধান হলো-

  • প্রযুক্তি-সংবেদনশীল আইন প্রণয়ন

  • আইন প্রণয়নে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সরাসরি যুক্ত করা

  • এআই ও অ্যালগরিদমের জন্য স্বচ্ছতা ও অডিট ব্যবস্থা

  • নাগরিকদের ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি

আইন যদি প্রযুক্তির ভাষা না বোঝে, তাহলে সে কখনোই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

শেষ কথা

প্রযুক্তি নিজে ভালো বা খারাপ নয়, তার ব্যবহারই তাকে বিপজ্জনক বা সম্ভাবনাময় করে তোলে। কিন্তু যখন প্রযুক্তির গতি আইনকে ছাড়িয়ে যায়, তখন ঝুঁকির বোঝা গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে।

প্রশ্ন তাই - শুধু এটুকু নয়, প্রযুক্তির গতিতে আইন পিছিয়ে পড়ছে কি না;

প্রশ্ন হলো- এই দৌড়ে আমরা নাগরিকের অধিকারকে সঙ্গে নিতে পারছি তো?

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com